ফ্রি ওয়াইফাই জোন চালু হয়েছে ঝালকাঠির ভীমরুলি ভাসমান পেয়ারা বাজারে। পেয়ারা এখন এ জেলার সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঝালকাঠির পেয়ারার সম্ভাবনা নজর এড়ায়নি সরকারেরও। স্থানীয় বিখ্যাত পণ্যের বিকাশের জন্য জেলা ব্র্যান্ডিং ব্যবস্থা চালু হলে ঝালকাঠির ব্র্যান্ড হিসেবে শীতলপাটির পাশাপাশি পেয়ারাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেøাগান নির্ধারণ করা হয়, ‘পেয়ারা আর শীতলপাটি, এ নিয়ে ঝালকাঠি’। ভাসমান বাজার থেকে অনলাইনে পেয়ারা বিক্রি করতে পারেন কৃষকরা।
জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের তালিকায় জায়গা পেয়েছে বাংলার আপেলখ্যাত মৌসুমি এ ফলটি। গত বছর ঝালকাঠির এই ভাসমান হাট-বাজার পরিদর্শন করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। পরিদর্শন শেষে তিনি ফ্রি ওয়াইফাই জোন চালুর প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি ঝালকাঠির ভীমরুলি বাজারে চালু হয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই জোন, যার মাধ্যমে কৃষকরা তাদের পণ্য অনলাইনে দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন।
প্রতিবছর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও যশোর থেকে পাইকাররা এসে পেয়ারা কিনে নেন। কিন্তু এ বছর বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারির কারণে পাইকাররা আসছেন না। আসছেন না দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও। তাই অন্য বছরগুলোর তুলনায় এ বছর পেয়ারার দামও অপেক্ষাকৃত অনেক কম। প্রতিমণ পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৩শ’ টাকায়। দাম নিয়ে হতাশায় আছেন পেয়ারা চাষিরা।
ঝালকাঠিতে পেয়ারা চাষ শুরু হয় প্রায় ২শ’ বছর আগে। তখন ঝালকাঠি ছিল বাকেরগঞ্জ জেলার অধীনে বরিশালের একটি অংশ। বর্তমানে ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা, গাভারামচন্দ্রপুর ও নবগ্রাম ইউনিয়নকে ঘিরে জেলার পেয়ারা চাষ বিকাশ লাভ করেছে।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমে ঝালকাঠিতে প্রায় ৭৫০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন প্রায় ১০ হাজার কেজি। সে হিসাবে এক মৌসুমে ঝালকাঠিতে প্রায় ৭৫ লাখ কেজি পেয়ারা উৎপাদন হয়। এ জেলায় স্বরূপকাঠি, মুকুন্দপুরী ও চায়না জাতের পেয়ারার চাষ হয়।
সাধারণত পেয়ারা গাছে মাঘ মাসে ফুল আসে। পরপর তিনবার ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় একেকটি গাছ। আষাঢ়ের দিকে গাছে গাছে পেয়ারা পুষ্ট হতে শুরু করে। ওই সময় থেকেই বাজারে পাওয়া যায় ঝালকাঠির বিখ্যাত পেয়ারা। ভাদ্র পর্যন্ত বাজারে পেয়ারা বেচাকেনা হয়। সেই হিসাবে বর্ষাকাল তথা আষাঢ়-শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পেয়ারার ভরা মৌসুম।
ঝালকাঠির পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি ভাসমান হাটের নাম। নৌকায় পাকা পেয়ারা নিয়ে ট্রলারে থাকা পাইকারদের সঙ্গে দরকষাকষি করে পছন্দমতো মূল্য পেলেই বিক্রি করে দেন পেয়ারা চাষিরা। এ ভাসমান হাট দক্ষিণবঙ্গে ফলের সবচেয়ে বড় বাজার।
ভীমরুলি খালের ভাসমান হাটে আশপাশের ১০ গ্রাম থেকে প্রতিদিন শত শত নৌকা ভেড়ে এই ভাসমান হাটে। প্রতিটি নৌকায বোঝাই করা থাকে মণকে মণ পেয়ারা। পাইকাররা আসেন ট্রাক ও বড় ট্রলার নিয়ে। দম ফেলার সময় নেই কারও। দরদাম চলে। চলে ট্রাকে পেয়ারা লোড-আনলোড। পুরো বিপণনই সম্পন্ন হয় পানির ওপর।
ভীমরুলি হাটের পেয়ারা বিক্রেতা গৌতম মিস্ত্রি জানান, ৫০-৬০ বছর আগে থেকে প্রতি মৌসুমে এ হাট বসছে। গৌতম মিস্ত্রি আরও জানান, মৌসুমের শুরুতে প্রতিমণ পেয়ারা ৩শ’-৪শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুরুর দিকে বেচাকেনা কম হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি মৌসুমে ভাসমান এই হাটে প্রায় ২ কোটি টাকার পেয়ারা বেচাকেনা হয়।
ভীমরুলিতে পেয়ারার ভাসমান হাটকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ এই হাট দেখতে আসে। ভীমরুলি ভাসমান হাটের প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে ইকোরিসোর্ট খুলে পর্যটন ব্যবসায় নেমেছেন অনুপ হালদার। তিনি জানান, ভীমরুলি হাট ঘিরে পর্যটকদের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে।
কীর্তিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস শুক্কুর মোল্লা জানান, প্রতিদিন দোশ-বিদোশ পর্যটক আসেন এখানে। গত বছরের জুলাই মাসে ঝালকাঠির পেয়ারা বাগান ও ভীমরুাাল ভাসমান হাট পরিদর্শন করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। ওই সময় তিনি বলেন, ‘থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের বিভিন্ন বড় শহরে এমন ভাসমান বাজারের দেখা মেলে। তবে বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জলে ভাসা বাজার-হাট গড়ে ওঠা সত্যিই অবাক করার মতো…।’
এর আগে ২০১৮ সালে ভীমরুলিতে ভাসমান হাট পরিদর্শন করেছেন তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রীংলাও।
ঝালকাঠিতে পেয়ারার উৎপাদন ও বিক্রি বর্তমানের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ লক্ষ্য পূরণে পেয়ারার জাত সংরক্ষণ, আধুনিক ও প্রযুক্তিগত চাষ ব্যবস্থার বিকাশে চাষিদের প্রশিক্ষণ, নতুন নতুন বাগান সৃজন করা, পেয়ারা সংরক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু উদ্যোগ পরিকল্পনাধীন। এমনকি এখানকার পেয়ারা শুধু ফল হিসেবে বিক্রি না করে জ্যাম-জেলিসহ বিকল্প পণ্য তৈরির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের
উপপরিচালক মো. ফজলুল হক জানান, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জেলার পেয়ারা চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সবধরনের সহযোগিতা করা হয়।