• ঢাকা
  • শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
শেখ হাসিনার প্রস্তাব আমেরিকা ও চীনের খেলা -আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

শেখ হাসিনার প্রস্তাব আমেরিকা ও চীনের খেলা -আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

করোনা সংকটকে যেমন জাতীয় পর্যায়ে মোকাবেলা করতে হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও করার জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের ডাক দিয়েছেন শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে এই সমন্বিত কার্যক্রমের জন্য পাঁচ দফা প্রস্তাবও দিয়েছেন। এটি যদি বিশ্বের উন্নত ও ধনী দেশগুলোর নেতাদের কানে ঢোকে, তাহলেই মঙ্গল। এর আগে অনেক বড় বড় সংকট থেকে তিনি দেশকে বাঁচিয়েছেন, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিশ্বসমস্যায় ছোট ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবিদাওয়া আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে প্রশংসা অর্জনও করেছেন। তাঁকে উপাধি দেওয়া হয়েছে মাদার অব দি আর্থ—বিশ্বজননী। এবারের করোনাভাইরাসের মতো বিশ্বসংকটে তিনি একই মাতৃহূদয়ের আকুতি ও দূরসংকল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।

শেখ হাসিনা সংকটের গোড়া থেকেই এ সম্পর্কে সতর্ক হয়েছিলেন এবং এখনো যে সতর্ক আছেন, তার পাঁচ দফা প্রস্তাব থেকেই তা বোঝা যায়। এবারের সংকট যে কত ভয়ংকর, সে কথা তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন; তাঁর জনগণের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করেননি। গত ২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা বিষয়ক ভার্চুয়াল সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সবাইকে একযোগে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে।’ এই ভার্চুয়াল সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম।
এই ভার্চুয়াল সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশ্ব সম্ভবত গত ১০০ বছরের মধ্যে এত বড় সংকটের মুখোমুখি হয়নি। সুতরাং সবার একসঙ্গে সংকটের মোকাবেলা করা দরকার। প্রতিটি সমাজ থেকে সমন্বিত দায়িত্বশীলতা ও অংশীদারিমূলক মনোভাব প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নতার নীতি বাস্তবতাসম্মত নয়। বিশ্ব এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যায় লড়াই করেছে। এখন করোনাভাইরাস আমাদের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বিশ্বায়নের বর্তমান পর্যায়ে একটি দেশকে পুরো বিশ্ব থেকে আলাদা রাখা সম্ভব নয়। এখানে বিচ্ছিন্নতার নীতি আর কাজ করবে না।’

এই সতর্কবাণী উচ্চারণের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা জানি না এই মহামারি আর কত দিন থাকবে। এটা এর মধ্যেই অর্থনীতিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক কার্যকলাপ ফিরিয়ে আনতে হবে। ভয় ও ট্রমা কাটাতে জনগণকে সহযোগিতা দিতে হবে।’ এর পরই বিশ্বের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা পুনর্গঠনের জন্য তিনি পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন।

এই প্রস্তাবগুলো হলো—এক. মানবকল্যাণ, বৈষম্য দূরীকরণ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তাদান এবং কভিড-১৯-এর আগের অর্থনৈতিক অবস্থায় বিশ্বকে ফিরিয়ে নিতে নতুন পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে। দুই. আমাদের প্রয়োজন জি-৭, জি-২০ এবং ওইসিডির মতো সংগঠনগুলো থেকে দৃঢ় ও পরিকল্পিত বৈশ্বিক নেতৃত্ব। জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকেও এগিয়ে আনা। তিন. এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনব্যবস্থায় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কভিড-পরবর্তী সময়ে নতুন নীতি, নতুন স্ট্যান্ডার্ড ও রীতিনীতি দেখা যাবে। সরবরাহ শৃঙ্খলে থাকা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে না। তাতে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর। সুতরাং এই দেশগুলোর টিকে থাকার জন্য বাস্তবমুখী সহায়তাব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
চতুর্থ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, অভিবাসী কর্মীরা বেকারত্বসহ অত্যন্ত কঠিন অবস্থা পার করছেন। সুতরাং এই বোঝা ও দায়িত্ব শেয়ার করার মতো বৈশ্বিক কৌশল ও পরিকল্পনা নিতে হবে। পাঁচ. এই মহামারির সময়ে কার্যকরভাবে বেশ কিছু ডিজিটাল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভাইরাস চিহ্নিত করা। ভবিষ্যতের প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন সেক্টরে এ রকম উদ্ভাবনীমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শেখ হাসিনার এই প্রস্তাবগুলোর বৈশিষ্ট্য এই যে এগুলো উন্নত দেশগুলোর প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে করা হয়েছে। বর্তমান দুর্যোগ গোটা বিশ্বের মানুষকে আঘাত করেছে এবং এই আঘাত প্রতিহত করার জন্য বিশ্ববাসীকে সমস্ত বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়েছে। শেখ হাসিনার প্রস্তাব করোনাবিধ্বস্ত বিশ্বের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা যথাযথ সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন বড় দেশগুলো নিজেদের পারস্পরিক কলহ মিটিয়ে যুক্তভাবে এই পরিকল্পনা তৈরি করবে এবং জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে ছোট দেশগুলোকেও কাছে টেনে এনে সম্মিলিত শক্তি বিশ্বকে পুনর্গঠনের কাজে লাগাবে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদ যখন গোটা বিশ্বের জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন মানবতা রক্ষার জন্য ক্যাপিটালিজম ও কমিউনিজমকে হাত মেলাতে হয়েছিল। করোনার চ্যালেঞ্জ ফ্যাসিবাদের চ্যালেঞ্জের চেয়েও ভয়াবহ। এই সময় আশা করা গিয়েছিল, বর্তমান বিশ্বের দুই সুপারপাওয়ার আমেরিকা ও চীন, সঙ্গে রাশিয়া ও ভারতও এই বিশ্বদানবকে দমনে হাত মেলাবে এবং ছোট, অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন পরিকল্পনায় (যে পরিকল্পনার কথা শেখ হাসিনা বলেছেন) যুক্ত রাখবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন জার্মানির পটাসডাম শহরে স্তালিন, চার্চিল ও রুজভেল্ট যুদ্ধোত্তর বিশ্ব পুনর্গঠনের আলোচনায় বসেছিলেন তখন ইউরোপের ছোট দেশগুলোর কথাও মনে রাখা হয়েছিল। বর্তমানের করোনা-পরবর্তী বিশ্ব হবে আরো বিধ্বস্ত। তার পুনর্গঠন পরিকল্পনাকে করতে হবে আরো বাস্তব ও বহুমুখী। কিন্তু আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা বিশ্বকে রক্ষার চেয়ে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমকে রক্ষায় অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তো গোড়ায় এই ভাইরাসসংক্রান্ত আগাম সতর্কবাণীকে কোনো গুরুত্বই দেননি। ট্রাম্প বলেছেন, এটা সাধারণ ফ্লু, দুই দিনেই চলে যাবে। কিন্তু এই ভাইরাসে যখন হাজার হাজার আমেরিকান মৃত্যুবরণ করছে তখনো এই মাথামোটা প্রেসিডেন্ট তাঁর গোঁয়ার্তুমি ছাড়েননি। তিনি প্রথমে জনসাধারণকে মাস্ক পরার উপদেশ দেননি। বরং এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আমেরিকায় আবিষ্কার করা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। সেই প্রতিষেধক ‘হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধ’ বলে প্রমাণিত হওয়া এবং সারা আমেরিকায় করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাওয়ার পরও তাঁর চৈতন্যোদয় হয়নি।

তিনি এখন এই ভাইরাস আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস করার জন্য চীনই বিশ্বময় ছড়িয়েছে বলে একটা প্রচারযুদ্ধ শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ব্রিটিশ জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে ‘দ্য মাউথপিস অব লাই অ্যান্ড ব্লান্ডার্স’ নামে পরিচিত ডেইলি মেইল এক লম্বা প্রতিবেদন ছেপে ট্রাম্প প্রপাগান্ডাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইকোনমিক সুপারপাওয়ারের অবস্থানটি আমেরিকার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্য চীনের কমিউনিস্ট শাসকরা বিশ্বে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে। কিন্তু একজন বিখ্যাত মার্কিন ভাইরোলজিস্ট বেশ কয়েক দিন গবেষণার পর শপথগ্রহণপূর্বক ঘোষণা করেছেন, করোনাভাইরাস চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়ায়নি।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে করোনা রোধের জন্য কোনো সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব কি না, তা এখন প্রশ্নের বিষয়। শেখ হাসিনা তাঁর নিজের সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে করোনার গ্রাস থেকে দেশকে বাঁচাতে পারবেন কি? আমার ধারণা, যদি কেউ তা পারেন, শেখ হাসিনাই পারবেন। এ ব্যাপারে তাঁর সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করার মতো বিচক্ষণতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর বড় বাধা দুর্বল সংগঠন ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র। হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী সময়মতো সতর্ক হলে ভাইরাস প্রতিরোধের সাজসরঞ্জাম তেমন না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে পরিস্থিতি এতটা গুরুতর হয়ে দাঁড়াত না।

জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী অবশ্যই ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদ্যাপন করতে হবে। কিন্তু সে জন্য কর্তাভজা এক দল আমলা তেলের ভাণ্ড হাতে যেভাবে সময় কাটিয়ে আসন্ন বিপদের দিকে তাকাননি, এখনো তাঁরা তা-ই করছেন। তা না হলে সরকার যখন শক্তভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, তখন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকার মুখে চট্টগ্রামের তিনটি ইপিজেডের ১১০টি কলকারখানা খোলা হচ্ছে কাদের নির্দেশে? এখনো কি সরকারি নির্দেশ অমান্য করা হচ্ছে না? রাতের আঁধারে ফের ঢাকার পথে আসছে দলে দলে পোশাক শ্রমিক। পুলিশের বাধাদান, লাঠিপেটা তারা মানছে না। কলকারখানা, পোশাকশিল্প চালু করতে হলে সরকার সময়মতো পরিকল্পনা অনুযায়ী করবে। কিন্তু তার আগে সরকারি নির্দেশ অমান্য করার কাজে সাহায্য করছে কারা? দেখা যাচ্ছে, সরকারের চোখের সামনে আইন ভাঙা হচ্ছে; কিন্তু সরকার নিরুপায়।

এর অর্থ কী? গুজবটা কত সত্য জানি না; কিন্তু বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এক দল প্রিয় পাত্রেরই দ্বারা তাঁর অজান্তে এই কাজগুলো হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে নাকি আছেন একজন মন্ত্রী এবং ঢাকার সাবেক এক মেয়রপত্নী। এই গুজব যদি সত্য হয়, তাহলে বলব, ‘ক্ষেতের বেড়াই ফসল খাচ্ছে, গরুকে দোষ দিয়ে লাভ কী?’

দেশ শেখ হাসিনার মতো সাহসী ও দূরদর্শী এক নেতা পেয়েছে, এ জন্য আমি গর্বিত। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তিনি জয়ী হবেন। আমার দুঃখ, এমন এক সাহসী নেত্রীর চারপাশে তোয়াজ করার লোক অনেক আছে; কিন্তু তাঁকে সৎ ও সুপরামর্শ দেওয়ার লোক একজনও নেই—না তাঁর পরিবারে, না তাঁর সংগঠনে, না তাঁর প্রশাসনে। তিনি আজ বড় একা!  কালের কন্ঠ

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

এপ্রিল ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« মার্চ    
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।