সময়ের আলোর সংবাদ
এবার নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট আসছে একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। করোনাকালে এই বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও, বাজেট হতে যাচ্ছে একেবারে সংবেদশীল ও জনবান্ধব। যেখানে জনগণের ওপর তেমন কোনো চাপ বাড়বে না। বরং দেশের সাধারণ মানুষ থেকে একেবারে ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা যেন তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়ে বাজেট তৈরি হচ্ছে। নতুন কোনো করের চাপ থাকছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে করের ছাড় থাকতে পারে। বর্তমানের তুলনায় সামাজিক সুরক্ষা আরও বাড়বে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তি খাতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়তে পারে। কমতে পারে করপোরেট কর। কালো টাকা সাদা করার আরও সুযোগ বাড়তে পারে। মোট কথা করোনাকালে অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক কার্যক্রম রাখা হবে। কৃষি, স্বাস্থ্যও কর্মসৃজন খাতে বরাদ্দ অন্য অর্থবছরের তুলনায় বাড়ছে। এমন অনেক প্রকল্প নেওয়া হবে যেন দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। দ্বিতীয় বারের মতো বাজেট
অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর চলতি অর্থবছরের জন্য প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে বাজেট বক্তৃতা পাঠের সময় তিনি যখন বারবার সমস্যায় পড়ছিলেন। তখন ত্রাতা হিসেবে আর্বিভূত হন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের সময় সরকারপ্রধান হিসেবে এর আগে কেউ কখনও সংসদে বাজেট বক্তৃতা পাঠ করেননি। এবার অর্থমন্ত্রী সুস্থ্য। তাই তিনি দ্বিতীয় বারের মতো আগামি ১১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন।
কত টাকার বাজেট আসছে?
আগামি অর্থবছরে বাজেটের আকার ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেটের আকার হচ্ছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। যা ইতোমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ১৯ মে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কত?
আগামি অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে। এর মধ্যে শুধুমাত্র এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় দেড় শতাংশ বেশি। রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের লক্ষ্য এখন রাজস্ব আহরণ নয়। ক্ষতি পোশানো এখন প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়াও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আগামি বাজেটে যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানে কর ছাড় দেয়া হবে। এ ছাড়া আগামি অর্থবছরে করের তেমন চাপ বাড়বে না। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এর মধ্যে অন্যতম কারণ, করোনা ভাইরাস।
কেমন হচ্ছে আগামি বাজেট
আগামি বাজেটে ব্যক্তি খাতে স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়তে পারে। বর্তমানে বার্ষিক করমুক্ত আয়ের সীমা রয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আগামিতে এটি ৩ লাখ টাকা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে করের হারও কমতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ হতে পারে। করপোরেট করের হার নতুন অর্থবছরে কমতে পারে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন সব কোম্পানির কর হার ৩৫ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে এই হার আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। তবে আগামি বাজেটে শুধুমাত্র একটি স্তরে কর হার কমতে পারে। অন্য সব ধাপে তেমন পরিবর্তন নাও আসতে পারে। ব্যবসা বাণিজ্যের কার্যক্রম সচল রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা করপোরেট কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও মেট্রোপলিটন চেম্বার এ ব্যাপারে তাদের অনলাইনে যে প্রস্তাব দিয়েছে এর মধ্যে করপোরেট কর হার কমানোর বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে নানামুখী সংস্কার করে কর আদায় বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে এই বাজেটে।
ছাড় যেখানে অগ্রাধিকার পাবে
করোনা ভাইরাস সংক্রমণে প্রতিরোধে যারা মাস্ক, পিপিইসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী ও মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবে তাদের নির্ধারিত হারে কর ছাড়ের প্রস্তাব থাকছে আগামি বাজেটে।
আগামিতে ভ্যাট
আগামি বাজেটে ভ্যাটের তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না বলে আভাস পাওয়া গেছে। বর্তমান যে হার বহাল রয়েছে তাই থাকবে আগামি বাজেটে। তবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিগারেটের সর্ম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে। আমদানি পর্যায়ে খুব বেশি পরিবর্তন আসছে না। তবে অপ্রয়োজনীয় বিলাস পণ্য আমদানিতে নিরৎসাহিত করা হবে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
বাজেটে নিদিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। আর ক্ষেত্রটি হচ্ছে শিল্প ও ফ্ল্যাট কেনা। এ ছাড়াও নির্ধারিত বা প্রযোজ্য হারের সঙ্গে অতিরিক্ত কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যায়। তবে আগামি বাজেটে এই সুযোগ আরও বাড়তে পারে। অর্থাৎ পরিধি বাড়তে পারে। কেন এই সুযোগ? এই প্রশ্নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্বশীল অপর এক কর্মকর্তা জানান, করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই এই সুযোগ অবারিত হতে পারে। এ ছাড়াও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ও রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আপাততঃ কালো টাকা সাদা করার জন্য দুটি উপায় চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে। একটি টালাওভাবে বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ, অপরটি হচ্ছে বিদ্যমান কালোটাকা সাদা করার সুবিধা সম্প্রসারণ করা। মূলত কালো টাকা মূল অর্থনীতির ¯্রােতে আসার সুযোগটাই মূল উদ্দেশ্যে। যেখানে বিনিয়োগ বাড়বে আর অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
আগামি বাজেটে বাড়ছে সামাজিক সুরক্ষা
স্বাস্থ্য ও কৃষির পাশাপাশি আগামি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাত অনেক অগ্রাধিকার পাবে বলে অর্থবিভাগ সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় বয়স্ক, বিধবাসহ অন্যান্য ভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৮১ লাখ। আগামি অর্থবছরে নতুন করে আরও ১২ লাখ যুক্ত হতে পারে। আসন্ন আজেটে অতিরিক্ত ৮ লাখ ৫০ হাজার লোক বিধবা ও বয়স্কভাতা পাবেন। এর মধ্যে আড়াই লাখ বাড়তে পারে প্রতিবন্ধী ভাতা ও শিক্ষা বৃত্তি। মুক্তিযোদ্ধ ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে আরও ১০ হাজার। দরিদ্রতম ১০০টি উপজেলার শতভাগ যোগ্যকে ভাতার আওতায় আনা হবে।
এডিপিতে অগ্রাধিকার প্রকল্প
আগামি এডিপিতে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত অগ্রাধিকার পাচ্ছে। করোনার সংক্রমণ রোধ ও অর্থনীতিতে এর অভিঘাত মোকাবেলা করার জন্য স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি খাতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
বাজেট ঘাটতি আর মূল্যস্ফীতি কত?
আগামি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হতে পারে জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ ৫ শতাংশর মধ্যে ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ আগামি অর্থ বছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর মূল্যস্ফীতি ধরা হতে পারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
বেতন ভাতাসহ অন্যান্য প্রণোদনা
আগামি অর্থবছরে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হতে পারে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের মধ্যে আরও রয়েছে দেশি-বিদেশি সুদ, অবসর ভাতা ইত্যাদি। চলতি বছর এই অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ
আগামি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ধরা হলেও, শেষ পর্যন্ত তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
সঞ্চয়পত্র
আগামি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও, শেষ পর্যন্ত ১২ হাজার টাকায় দাঁড়াতে পারে।
বিদেশি ঋণ
আগামি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হতে পারে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ বাবদ থাকছে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
রেলযাত্রীদের জন্য বীমা
আগামি অর্থবছরে রেলযাত্রীদের কাছ থেকে নামমাত্র প্রিমিয়াম নিয়ে তাদের জন্য বীমা সুবিধা চালু হতে পারে। আর এই বাজেটে এটাই হতে পারে নতুন কর্মসূচি।
কৃষি খাতে ভর্তুকি
আগামি বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে কৃষির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। খাদ্য ও কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ এ যাবৎ কালে সবচেয়ে বেশি হতে পারে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।