জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে। বাংলাদেশও এ খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই মধ্যে বিকল্প জ্বালানির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব শ্রেণীর নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহৃত হয় তা হলো- পানি বিদ্যুৎ; সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুৎ; বায়ু বিদ্যুৎ; পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ; গোবর এবং পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস; বাতাসের গতি; ধানের তুস এবং ইক্ষুর ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্প প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি উৎপাদন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রাকৃতিকভাবে প্রতিস্থাপিত হয় এবং পুনঃব্যবহার করা যায়। ফলে এটি পরিবেশের জন্য খুব উপকারী এবং সাশ্রয়ীও। অক্সিজেন, স্বচ্ছ পানি, সৌরশক্তি, কাঠ, কাগজ, বৃক্ষলতা থেকে প্রাপ্ত নানা ধরনের জৈব উপাদান, চামড়া প্রভৃতিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বিভিন্ন খাদ্যশস্য, তেলবীজ, প্রাণিজবর্জ্য প্রভৃতির মাধ্যমে কিছু সহজ ও সস্তা প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদন করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা বিদ্যুৎ পাওয়ার তিনটি উপায় হচ্ছে—সূর্য, বায়ু ও পানি। বাংলাদেশে অবারিত ও পর্যাপ্ত সূর্যালোক রয়েছে। এরই মধ্যে দেশে সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ছাড়া পানিবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর ও পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস এবং ধানের তুষ ও ইক্ষুর ছোবড়া থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন শুরু হয়েছে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্জন সম্ভব। ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারলে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিদ্যুতের দাম প্রতি কিলোওয়াট এখন ১৫ টাকা। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটাতে পারলে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তিন থেকে চার টাকায় পাওয়া সম্ভব।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০২০ সালের আজকের দিন পর্যন্ত (১৭ জুন) আমরা ৬৬৯.২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি৷ এর মধ্যে সোলারে ৬৫ শতাংশ বা ৪৩৫.৩৫ মেগাওয়াট এবং হাইড্রো থেকে ২৩৯ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ এই পর্যন্ত আমরা প্রায় ৬ শতাংশের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারছি পরিবেশসম্মত এই জ্বালানি থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত বাংলাদেশের জ্বালানির প্রধান উৎস হতে হয়তো অনেক সময় লাগবে, তবে এ খাত বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরশীল খাতে পরিণত হবে। সেই মহাপরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
বিদ্যুৎ বিভাগের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেলের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়ও এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এটি নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও গবেষণা হচ্ছে। যেসব প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়েছে, সেটি সমাধান করে কীভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানো যায় সেই প্রচেষ্টা সরকার করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের জন্য যে উপকরণগুলো লাগে বিশ্বে তার প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি হয় চীনে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আমরা যে উপকরণগুলো আনছি, তার অধিকাংশই দেশটি থেকে আসতো। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সব ধরনের উপকরণ আসা বন্ধ হয়ে গেছে।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই অবস্থায় চলতি বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমরা যে কাজ করছি, তা এই বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করতে পারছি না। তবে প্রকল্প চলমান থাকবে। প্রয়োজনে সময়সীমা বাড়িয়ে কাজ সম্পন্ন করা হবে।’’
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের নতুন বাজার সম্প্রসারণে ‘দি স্কেলিং আপ রিনিউঅ্যাবল এনার্জি প্রজেক্ট’, ‘ইউটিলিটি স্কেল সোলার ফোটোভেলটেক (পিভি)’ এবং ছাদের বা রুফটপ পিভির প্রতিও দৃষ্টি রয়েছে সরকারের। গত বছরের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ লক্ষ্যে প্রায় ১ হাজার ৫৭২ কোটি ৫ লাখ টাকার ঋণচুক্তি হয়। এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতায় প্রায় ৩১০ মেগাওয়াট যোগ হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘‘সরকার ২০২০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এটি দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকার সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ৩২টি সোলার পার্ক স্থাপনের কাজ চলছে। কিছু সোলার পার্ক উৎপাদনে এসেছে।’’
করোনাভাইরাস ইস্যুতে এখাতে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েই কাজ করবেন বলে জানান তিনি।
বিদ্যুৎ বিভাগের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও নাবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে বলা আছে৷ এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে৷ বর্তমানে সাময়িক সমস্যা তৈরি হলেও কোভিড-১৯ সরকারের মহাপরিকল্পনায় খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে জানান তিনি।