ইতিহাসে সম্ভবত স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক এখন বার্সেলোনা এবং মেসির মধ্যে। দুই পক্ষই এখন যেন একে অপরের চক্ষুশুল। কিছুদিন আগেই ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। যদি তেমনটা ঘটেই, তাহলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, বার্সার সঙ্গে তিনি এখনও পর্যন্ত নতুন কোনো চুক্তিতে জড়াননি। আগামী মৌসুমেই যে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
যেহেতু ২০২১ সালের জুনে বার্সার সঙ্গে মেসির চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার, সে কারণে বার্সা এবার চেয়েছিল সেই চুক্তি নবায়ন করে নিতে। কিন্তু মেসি তাতে একেবারেই সাড়া দিলেন না। বার্সার প্রস্তাব প্রকারান্তরে প্রত্যাখ্যানই করেছেন বলা যায়।
এরই মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে লা লিগা চ্যাম্পিয়নশিপ হারিয়েছে বার্সা। একের পর এক ম্যাচ ড্র কিংবা পরাজয়ের কারণে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। বিশেষ করে ওসাসুনার কাছে হারের পর নিজের ক্ষোভ উগড়ে দেন মেসি। জানিয়ে দেন, এমন অধারাবাহিক এবং কুৎসিৎ বার্সা তিনি এর আগে দেখেননি।
তার আগেই কোচ সিসে সেতিয়েনের সঙ্গে মেসির বিরোধ প্রকাশ্যে এসে পড়েছিল। প্রকাশ্যেই কোচের সমালোচনা করেছিলেন বার্সার এই সুপারস্টার। এবার যখন মেসি নিজ দলের সঙ্গে ক্ষোভ উগড়ে দেন, তার কড়া জবাব দিয়েছেন কোচ সেতিয়েনও। তিনি মেসির বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়ে দেন, তিনি যেভাবে বলেছেন বার্সা তেমন নয়।
আবার ইনস্টাগ্রামে মেসি সম্প্রতি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিকে ফলো করা শুরু করেছেন। যার কারণে অনেকেই মনে করছেন, এটা কি তাহলে মেসির বার্সা ছাড়ার ইঙ্গিত। তিনি কি তবে ম্যানসিটিতে তার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলার কাছেই ফিরে যাচ্ছেন?
ইএসপিএন সকারের সিনিয়র ফুটবল লেখক গ্যাব্রিয়েল মারকোত্তি একটি বিশ্লেষণ লিখেছেন। তিনি তার লেখায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মেসির রাগ মূলতঃ বার্সার ফ্রন্টলাইনের ওপর। তথা, বার্সা কর্মকর্তাদের ওপর। মেসিকে ঘিরে যাদের খেলার কথা, তাদের রিক্রুটমেন্টের বিষয়ে মেসির মতামতকে আগ্রাহ্য করা, ক্লাবের অভ্যন্তরে কিছু ব্যক্তির অহেতুক ক্ষমতার চর্চা এবং সম্প্রতি বার্সার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অসন্তুষ্টি মেসিকে নতুন চুক্তির বিষয়ে অনাগ্রহী করে তুলেছে।
তবে মেসির অবস্থান নিয়ে বার্সার কারো পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য এখনও আসেনি, শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট হোসে মারিয়া বার্তেম্যু ছাড়া। বার্সা প্রেসিডেন্ট অনেকটা কৈফিয়তের সুরেই জানিয়েছেন, মেসি বার্সা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। তিনি বার্সাতেই থাকবেন এবং বার্সা থেকেই অবসরে যাবেন।
বার্সার সঙ্গে মেসির বন্ধন এখনও একটি বছর বাকি। এরপরই তিনি হয়ে যাবেন ফ্রি। তার কোনো রিলিজ ক্লজও থাকবে না। এর মধ্যে অবশ্যই অন্য কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে তার এবং ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে হয়তো অন্য কোনো ক্লাবে দেখা যেতে পারে।
১৩ বছর বয়স থেকেই বার্সেলোনায় রয়েছেন মেসি। এখন তার বয়স ৩৩। অর্থ্যাৎ, পাক্কা দুই দশক তিনি ন্যু ক্যাম্পে কাটিয়ে দিলেন। এবার ন্যু ক্যাম্পের সঙ্গে মায়ার বন্ধন ছিন্ন করার সম্ভাবনাটা যেভাবে তৈরি হয়েছে, তাকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এবারের মত এর আগে আর কখনো এতটা শক্তভাবে বার্সা ছাড়ার ইঙ্গিত দেননি তিনি।
তবে, মেসির বার্সা ছেড়ে না যাওয়ারও একটা দারুণ সম্ভাবনা আছে। অর্থ্যাৎ, তার সমস্যার কারণ যদি হয়ে থাকে ক্লাব প্রেসিডেন্ট বার্তেম্যু এবং ক্লাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা, তাহলে তাদেরও ২০২১ সালে বার্সার অফিস ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, সামনেই ক্লাবের নির্বাচন। বার্তেম্যুর আরেকবার নির্বাচন করার সম্ভাবনা কম। তেমনটা হলে বার্সার পরিচালনা পর্ষদে নতুন কেউ আসবেন এবং মেসির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবেন।
সে যাই হোক, মেসির বার্সা ছাড়ার গুঞ্জনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেলো লা লিগার এবারের মৌসুম। বাকি আছে আর শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এরপর শুরু হবে আরেকটি মৌসুম। বার্সার মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে কোচ সিসে সেতিয়েনকে হয়তো বিদায় করে দেয়া হবে। তেমনটা হলে আগামী মৌসুমে আসবেন নতুন কোচ। তাতে কি মেসির অবস্থানের পরিবর্তন হবে? বোঝা মুস্কিল।
যদি সত্যি সত্যি ন্যু ক্যাম্পের সঙ্গে বন্ধনটা ছিন্ন হয়েই যায় মেসির, তখন লা লিগায় কিংবা উয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপে কি করবে বার্সা? গত প্রায় দেড় দশক এই এক মেসিকে পোস্টারবয় বানিয়ে খেলে গেছে ক্লাবটি। স্পেন, ইউরোপ এবং বৈশ্বিক ফুটবলে দারুণ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল।
কিন্তু মেসি যদি বার্সা ছেড়ে যায়, তাহলে যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে, তা পূরণ হবে কি দিয়ে? ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে গেলেও ক্লাবটি ঘুরে দাঁড়াতে সময় নিয়েছে মাত্র এক মৌসুম। জিদানের অধীনে এবার তারা চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। বেনজেমা, হ্যাজার্ড, মদ্রিচ, ইসকো, ক্যাসেমিরো, মার্সেলো এবং রামোসদের মত তারকা থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু মেসি চলে গেলে বার্সার হাল ধরার মত তারকা কে আছেন? কোচই বা আছেন কে? কি হবে তখন ন্যু ক্যাম্পের ক্লাবটির? এই এক খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভরতা তৈরি হতে হতে ক্লাবের ভেতরে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ হবে কি দিয়ে? বার্সা ক্লাব কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ সমর্থকদের মনেও এখন উদয় হয়েছে এই চিন্তা।