চীন ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের ছয় মাস পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে এক কোটির বেশি মানুষ। তবে করোনাকালে এরই মধ্যে আর্থিকভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের কয়েকশ কোটি মানুষ। বিশেষত এশিয়া-আফ্রিকার তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের ওপর ক্ষতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে এবং পড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সহজেই এ ক্ষতির রেশ কাটবে না। বরং কাজ হারিয়ে কিংবা মজুরি কমে দরিদ্র মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগামী দিনগুলোয় ভঙ্গুর অর্থনীতি ও দারিদ্র্যের ধাক্কা সামলানোর বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলো।
জানুয়ারির শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণ এড়াতে একে একে লকডাউনে যায় চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলো। এখন লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একইভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে। টানা লকডাউনে এসব দেশে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, কৃষি ও শিল্পের সাপ্লাই চেইন। সাধারণ মানুষ দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হয়েছে। ফলে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে। বিশেষত হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতের বড় একটি অংশ পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েছে। বাদ যায়নি গণমাধ্যমও।
এক প্রতিবেদনে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) জানিয়েছে, করোনা মহামারীতে বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির ৮১ শতাংশ পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে কাজ হারাবে। সংখ্যার হিসাবে এর পরিমাণ ৩৩০ কোটি। এ বিষয়ে সংস্থাটির প্রধান গাই রাইডার বলেন, ব্যবসা কিংবা চাকরি—বিশ্বজুড়ে সব খাত করোনার প্রভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটা সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক মানবিক সংকট। আগামী দিনগুলোয় বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাটা সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়বে।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে খুচরা ব্যবসা, প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, আবাসন ও খাদ্য, পরিবহন, বিনোদন এবং আর্থিক খাতে বেকারত্ব রেকর্ড পরিমাণ বাড়বে। এসব খাতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ও স্বল্প দক্ষতার কাজে নিয়োজিত কর্মীদের ওপর ধাক্কাটা সবচেয়ে বেশি লাগবে। অনেক দেশে স্বল্প আয় করা নারী শ্রমিকরা ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে পারেন। আর অঞ্চলভেদে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শ্রমবাজার সবচেয়ে টালমাটাল হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে কর্মশক্তির ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ কাজ হারিয়ে বেকার হতে পারে।
এ তথ্যগুলোর ওপর চোখ বোলালে বিপদটা আন্দাজ করা যায়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীনির্ভর শ্রমবাজারের সিংহভাগ জোগান দেয় এশিয়া ও আফ্রিকার তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলো। করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে অভিবাসী কর্মীরা নিজ নিজ দেশে ফিরতে শুরু করলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে উত্তর-দক্ষিণ সব অঞ্চল। সাময়িক শ্রমিক সংকটে উত্তরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটাই শ্লথ হয়ে আসবে। কমে আসতে পারে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অর্থায়ন। আর দক্ষিণের দেশগুলো বিপুল বেকার জনগোষ্ঠী নিয়ে ধুঁকতে শুরু করবে। অস্থিরতা বাড়বে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে। এসব দেশের দরিদ্র মানুষ আরো প্রান্তিক অবস্থানে চলে যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংকটে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বের মাথাপিছু আর্থিক ক্ষতি ১ হাজার ৬০০ ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি পশ্চিমের ধনীদের চাপে ফেলবে। তবে তারা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে। অন্যদিকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র মানুষের পক্ষে এ ধাক্কা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। কেননা এসব অঞ্চলের অনেক দেশের মানুষের বার্ষিক গড় আয় ১ হাজার ৬০০ ডলারের কম। ফলে তারা খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, পুষ্টির মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এতে তাদের জীবনযাপনের লড়াই আরো জোরালো হয়ে উঠবে।
সম্ভাব্য এ বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এরই মধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ। তিনি বলেন, করোনার কারণে কাঠামোবদ্ধ অসাম্য, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে পড়েছে দরিদ্র মানুষ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হতে পারে তাদের। বিশেষত নারী, শিশু, বয়স্ক এবং বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের লড়াইটা জোরালো হয়ে উঠবে। কাঠামোবদ্ধ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
সংকট উত্তরণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করার পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, চলতি বছরই প্রায় ৯০ শতাংশ দেশ নিম্ন মাথাপিছু আয়ের সংকটে পড়বে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ কাজ হারাবে। বিশ্বজুড়ে অসাম্য বাড়বে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সমাজ—সবখানেই পরিবর্তন আসবে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আগাম পরিকল্পনা হাতে নেয়া জরুরি।
বিবিসি, সিএনবিসি ও ইউএন নিউজ অবলম্বনে