কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অ্যারোসল বিজ্ঞানী লিডিয়া মোরাওয়াস্কার শহর ব্রিসবেন, যেখানে রাস্তার ধারের চিহ্নগুলো একটি বার্তা প্রচার করছে, হাত ধোন, জীবন বাঁচান। এ বার্তা নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই, কারণ হাত ধোয়া সবসময় একটি বিধি। কিন্তু এই বার্তা সম্ভবত এখন পুরনো হয়ে গেছে।
হাতে আসা নতুন প্রমাণ বলছে, সার্স-কোভ-২ যা কিনা নভেল করোনাভাইরাসের জন্য দায়ী তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে অতিক্ষুদ্র ড্রপলেটের মাধ্যমে (যাকে অ্যারোসল বলা হয়। এটি এতই ক্ষুদ্র যে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে)। এটি বাতাসের ধাক্কায় ভেসে যেতে পারে এবং সময়ের সঙ্গে জমে যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে কিনা কয়েক মাস ধরে বিতর্ক চলছে। এর ট্রান্সমিশন রুট নিয়েও বিজ্ঞানীদের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এই সপ্তাহে মারোওয়াস্কা এবং ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে অ্যারোসল সায়েন্টিস্ট ডোনাল্ড মিল্টন আরো ২৩৭ জন ক্লিনিশিয়ান, সংক্রামক রোগের ডাক্তার, এপিডেমিওলজিস্ট, প্রকৌশলী এবং অ্যারোসল সায়েন্টিস্টদের দ্বারা সমর্থিত একটি ভাষ্য ক্লিনিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজ নামক জার্নালে প্রকাশ করেন। যেখানে মেডিকেল কমিউনিটি এবং জনস্বাস্থ্য অধিকর্তাদের কাছে আবেদন জানানো হয় করোনার বায়ুবাহিত সংক্রমণের সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নিতে। তারা এ সময় ঝুঁকি কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানও জানান।
গবেষকরা মূল এজেন্সিগুলো নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেছেন। যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যারা তাদের বার্তাগুলোর ওপর নজর দেয়নি। অবশ্য এই বিজ্ঞানীদের দেয়া ভাষ্যের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিজেদের অবস্থানকে কিছুটা নরম করেছে। ৭ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সমিশন নিয়ে নতুন গাইডলাইনে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং দুর্বল ভেন্টিলেশন নিয়ে নতুন নির্দেশিকা জারি করার কথা বলেছে। সংস্থাটির টেকনিক্যাল লিডার বেনেদেত্তা আলেগরানজি বলেছেন, এই প্রমাণের প্রতি আমাদের উন্মুক্ত থাকতে হবে এবং সংক্রমণের পদ্ধতির ওপর এর প্রভাব বুঝতে হবে। পাশাপাশি কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে তাও জানতে হবে।
মারওয়াস্কা বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্যে তিনি সন্তুষ্ট, স্বস্তি ও আনন্দিত বোধ করছেন। কয়েক মাস ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যারোসলের মাধ্যমে দুর্বল বায়ু চলাচল ব্যবস্থায় ভাইরাস ছড়াতে পারে এমন ধারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সংস্থাটি কেবল পৃষ্ঠতল থেকে ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়েছে, যেখানে কেবল অ্যারোসলের চেয়ে বড় ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যা কেবল হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এগুলো কেবল অল্প দূরত্ব পর্যন্ত চলাচল করতে পারে এবং দ্রুত বাতাস থেকে নিচে নেমে আসতে পারে।
এ ধরনের নির্দেশনা ভাইরাসের বাতাসে বিস্তৃতি ঠেকাতে নেয়া ব্যবস্থাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যেমন আবদ্ধ জায়গায় বায়ু চলাচল ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো এবং আবদ্ধ জায়গায় ভিড় সীমিত রাখা। এটা বর্তমান সময়ে এসে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সরকারগুলো লকডাউন তুলে নিচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যগুলো খুলে দিতে শুরু করেছে। মারওয়াস্কা বলেন, মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অবশ্য অনেক গবেষক এই সিদ্ধান্তটি পছন্দ করছেন না, কারণ এটা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলে আসা ধারণার বিপরীত। ১৯৩০-এর দশক থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অ্যারোসলের গুরুত্বকে এড়িয়ে গিয়েছেন। ২০১৯ সালের শেষ দিকে সার্স-কোভ-২-এর উত্থানের পরও একই ধারণা পোষণ করা হয়েছিল যে এটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। কিন্তু এখন এসে সেই ধারণায় ছেদ পড়েছে।
বহুদিনের বিতর্ক
ভাইরাসের বিস্তৃতির পথ নিয়ে চলমান বিতর্কের প্রভাব এটিকে থামাতে নেয়া উদ্যোগগুলোর ওপরও পড়ে। ক্ষুদ্র ও হালকা অ্যারোসলের টিকে থাকার সময় দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং বাতাসে জমে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু গবেষণাগুলো ফিরে যায় ১৯৩০-এর দশকে ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ওয়েলসের করা সেই মন্তব্যে। যেখানে তিনি বলেছিলেন বড় ড্রপলেটগুলো দুই মিটারের মধ্যে বাতাস থেকে পড়ে যায়।
যখন সার্স-কোভ-২ সামনে আসতে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্তারা জোর দেন বারবার হাত ধোয়া এবং শারীরিক দূরত্ব বিধি মেনে চলার ওপর। কোনো কোনো গবেষক এবং ক্লিনিশিয়ান বলেছেন এটুকুই যথেষ্ট। কন্টাক্ট ট্রেসিং ডাটাও এই বিধিগুলোকে সমর্থন করে। বিশেষজ্ঞদের একজন কেট গ্রাবোওয়াস্কি বলেন, মূলত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যেখানে একই বাসায় অনেকে থাকেন কিংবা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনেকে একই স্থানে থাকলে, সেখানে ড্রপলেট ট্রান্সমিশন দ্বারা এটি চালিত হয় বিশ্বাস করা হয়। পাশাপাশি তিনি অ্যারোসল ট্রান্সমিশন খুব বিরল ক্ষেত্রে দেখা যায় বলে জানান।
কিন্তু অন্য অনেক গবেষক বলেছেন, বৃহৎ আকারের পরীক্ষা দেখায় বাতাসে ভাইরাস ছড়ানোর ঘটনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে ইনডোরে জমায়েত হওয়ার পর ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে, ছয় ফুট সামাজিক দূরত্বের যে বিধি তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অ্যারোসল সায়েন্টিস্ট সান ডিয়েগো। ইনডোরে ভাইরাসের বিস্তৃতি বলছে এটি বিভিন্ন উপায়ে ছড়াতে পারে। আরেকজন বিশেষজ্ঞ পার্থার বলেন, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক কেমিস্ট হিসেবে আমি যা বুঝি, আপনি সেটা বাতাসে রাখেন এবং সবাই নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তা গ্রহণ করে। বাতাসে সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আরো অনেকগুলো উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন গবেষকরা।
বিপজ্জনক ড্রপলেট
অনেকগুলো উদাহরণ বলছে, অ্যারোসল ভাইরাস বহন করে। কিন্তু গবেষকরা নিশ্চিত হতে চান কখন এবং কীভাবে এটি ঘটে। সমস্যা হচ্ছে কাজটি করার সময় অ্যারোসলকে চিহ্নিত করা। ল্যাবরেটরির গবেষণাগুলো ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ফিরিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, যে ড্রপলেট হাঁচি-কাশিতে নির্গত হয় তা অ্যারোসলের চেয়ে বড়। ৫ মাইক্রোমিটারের বড় ড্রপলেট বাতাস থেকে দ্রুত পড়ে যায়, কারণ তারা খুবই ভারী। ফলে তারা বাতাসে চলাচল করতে পারে না।
কিন্তু আরো অনেক গবেষণা এখন ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে, দেখাচ্ছে ট্রান্সমিশন রুট হিসেবে অ্যারোসলের গুরুত্বকে। মে মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় স্বাস্থ্যবান স্বেচ্ছাসেবকদের কথা বলার সময় নির্গত ড্রপলেটগুলো লেজার লাইট দিয়ে চিহ্নিত করে। গবেষকরা হিসাব করে দেখিয়েছেন সার্স-কোভ-২-এর জন্য এক মিনিট জোরে কথা বললে ১ হাজার ছোট ভাইরাস বহনকারী ৪ মাইক্রোমিটারের অ্যারোসল নির্গত হয়। যা বাতাসে ৮ মিনিট ধরে থাকতে পারে। তারপর তারা এ সিদ্ধান্তে আসেন যে স্বাভাবিক কথা বলা সীমিত পরিবেশে বায়ুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন এসব প্রমাণের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। মোরাওয়াস্কা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একবার বললে সরকারগুলো তা অনুসরণ করবে। অন্যদিকে সংস্থাটিও এ বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলেও জানিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, মহামারীর শুরু থেকেই নানাভাবে সমালোচনার মুখে আছে এই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে অ্যারোসল ট্রান্সমিশন নিয়ে আর সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ নেই, এটি মোকাবেলায় এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
নেচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত