জুন ১৩, ২০২০
বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে নতুন কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হলে করোনার সম্ভাব্য সংক্রমণ রোধের জন্য এবং সার্বিকভাবে এলাকাবাসীকে সচেতন করার লক্ষ্যে আক্রান্ত রোগীসহ গোটা পরিবারটিকে আলাদা করে ওই ভবনটি বা পুরো এলাকা লকডাউন করার নিয়ম চালু করা হয়। লকডাউন আরোপ করার পর স্বভাবতই আক্রান্ত পরিবারটি বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং আক্রমণাত্মক ও অসহযোগিতামূলক আচরণের মুখোমুখি হতে শুরু করে। ফলে আক্রান্ত পরিবারটিকে এক ধরনের অসহযোগিতার ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণ মোকাবেলা করতে হয়। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা চিকিৎসার ঝুঁকিও সমান হারে বাড়ছে। চিকিৎসার ঝুঁকির সঙ্গে প্রতিবেশীদের বা পারিপার্শ্বিক আক্রমণাত্মক ও অসহযোগিতামূলক আচরণ যুক্ত হলে আক্রান্ত পরিবারের পক্ষে টিকে থাকা এবং চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। তাই করোনা প্রতিরোধে লকডাউন অত্যাবশ্যকীয় হলেও আক্রান্ত করোনা রোগীর সার্বিক সহযোগিতায় বিশেষ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ক্ষেত্রে লকডাউন আরোপ করার পর আনুষঙ্গিক যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তা দূর করা দরকার। অন্যথায় লকডাউন-সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে সবার মনে রাখা প্রয়োজন লকডাউন কোনো চিকিৎসা নয়, সংক্রমণ এড়ানোর জন্য এটি একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা মাত্র।
প্রতিবেশীদের আচরণগত পারিপার্শ্বিক অমানবিকতা কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, করোনার কবলে না পড়লে তা হয়তো কখনই ভালোভাবে জানা হতো না। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে খবরে পড়েছি অমানবিকতার নানা উদাহরণ। যেমন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে বাসায় ঢুকতে না দেয়া, করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত ডাক্তার পরিবারের ওপর এলাকাবাসীর আক্রমণ, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে এক রুমে আটকে রেখে তার কাছে পরিবারের কেউ না যাওয়া, এমনকি খাবার পর্যন্ত না দেয়া, করোনা আক্রান্ত অসুস্থ মাকে সন্তানের রাস্তায় ফেলে চলে যাওয়া, করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন করতে না দেয়া, করোনায় মৃত ব্যক্তিকে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া, হাসপাতালে ভর্তি না করায় বিনা চিকিৎসায় করোনা রোগীর মারা যাওয়া। এসব খবর পড়ে মনে হয়েছে মানুষগুলো অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও সংকীর্ণ মনের। তাদের মেধা-মননশীলতার বিকাশ ঘটেনি, তাই তারা এমন জঘন্য কাজ করতে পেরেছে। কোনো শিক্ষিত মেধা-মননশীলতায় বিকশিত মানুষের পক্ষে এমন গর্হিত কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষিত মানুষরাও করোনায় আক্রান্ত রোগীর প্রতি প্রত্যাশিত মানবিকতা প্রদর্শন করছে কিনা, তা ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
আমার স্ত্রী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৮ বছর ধরে আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায় থাকি। কিছুদিন আগে আমার স্ত্রীসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্যের করোনা শনাক্ত হলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। কারণ আমার স্ত্রীর ব্লাড প্রেসার ও কিডনির কিছু সমস্যা আছে। রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এলাকাটি লকডাউন ঘোষণা করে এবং আমাদের কিছু নির্দেশনা প্রদান করে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং সারা বাংলাদেশে শনাক্ত করোনা রোগীর প্রতি এলাকাবাসীর আচার-আচরণ ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ, করোনা রোগীর চিকিৎসা, করোনা রোগীর প্রতি কমিউনিটির আচরণ সম্পর্কিত মৌলিক বিষয় নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগে।
করোনা রোগ সংক্রমণ রোধে আরোপিত লকডাউনের মানে কি আক্রান্ত পরিবারটিকে একটি ফ্ল্যাটে আটকে রেখে পুরো এলাকাটির প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখা? রোগীর চিকিৎসাসেবার সুযোগ সীমিত করে দেয়া? চিকিৎসার জন্য রোগী বাইরে গেলে আর তাকে বাসায় ফিরতে না দেয়া? জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাজ কি শুধু গোটা পরিবারটিকে আইসোলেট করে ও লকডাউন আরোপ করে মিডিয়ায় বিবৃতি প্রদান করা? এটা তো করোনা রোগীকে চিকিৎসায় সহায়তা না করে এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দেয়ার শামিল। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচার-আচারণ যদি শিক্ষিত মানুষ ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নির্বাক দর্শকের মতো দেখতে থাকে তাহলে শিক্ষা, সভ্যতা ও নিয়ন্ত্রণের মূল্য কোথায়?
নভেল করোনাভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগী বা তার পরিবারের কেউ অথবা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসেছে ওই কমিউনিটির এমন কেউ যাতে অন্য কাউকে সংক্রমিত করতে না পারে, তার জন্যই মূলত এলাকাটি লকডাউন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। নভেল করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ লকডাউন ঘোষণা করে লাল পতাকা উড়িয়ে দেয় এবং ওই ভবন বা এলাকার প্রবেশদ্বার তালাবদ্ধ করে চাবি নিয়ে যায় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বা এলাকার মেম্বার বা কাউন্সিলর। লকডাউনের সময় করোনা আক্রান্ত পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় তাদের চিকিৎসা, কিন্তু সেই চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে গেলেও তাদেরকে এক ধরনের মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়; যা নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়েও ভয়াবহ। নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মারাত্মক কোনো কিছু নয়, বেশির ভাগ রোগী অল্প চিকিৎসাতেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু যাদের ক্রনিক সমস্যা থাকে বা শারীরিক-মানসিকভাবে অতটা সক্ষম নয়, তাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষা ও ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন হয়। এমন ক্ষেত্রে বাইরে যেতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলে আক্রান্তদের ওপর মানসিক চাপ পড়ে, যা এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ব তৈরি করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের আচরণ করা হয় করোনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার জন্য।
জেলা-উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের তড়িঘড়ি করে ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরো পরিবারটিকে আইসোলেট করে লাল পতাকা উড়িয়ে বাড়িটিকে বা এলাকাটিকে লকডাউন করার প্রচলিত নিয়মের ফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে ভুল ধারণাও সংক্রমিত হয়। এলাকার লোকজন আরো বেশি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজেদের সুরক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, যার ফল হয় ভুক্তভোগী পরিবারটির জন্য ভয়াবহ। এলাকাবাসী তখন ওই পরিবারটিকে সহায়তার পরিবর্তে নিজেদের সুরক্ষার জন্য এলিমিনেট করতে মারমুখী হয়ে এগিয়ে যায়। এমনকি যে ডাক্তার অসুস্থ হলে এলাকাবাসীকে চিকিৎসা দেয় বা দেবে, সেই ডাক্তারকেও তারা হেনস্থা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এক্ষেত্রে তারা কোনো সামাজিক রীতি-নীতি, বিচার-বুদ্ধি বা বিবেকের ধার ধারে না।
নভেল করোনাভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে, কিন্তু ভাইরাসটির হাত-পা নেই যে এটি দৌড়ে বা হেঁটে এসে আপনার গায়ে উঠবে। নিরাপদ দূরত্বে থাকলে এ ভাইরাস আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনি করোনা রোগীর কাছাকাছি যেতে পারবেন এবং তাকে সহযোগিতা করতে পারবেন। আপনার আবাসিক এলাকার একজন নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে বলে সে বা তার পরিবারের কেউ চিকিৎসার জন্য বাইরে গেলে ফিরে আসতে পারবে না—এমনটা ভাবার বা বলার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। আপনার আবাসিক এলাকার নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগী তার বাসা থেকে নেমে গাড়ি চালিয়ে বা রিকশায় করে হাসপাতালে গেলে আপনার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে ভেবে শঙ্কিত হওয়াটা আপনার অজ্ঞতা ও বোকামি। বরং আপনার উচিত তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাকে সহায়তা করা।
বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে কয়েক কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে। আক্রান্ত এই মানুষের বেশির ভাগ বিনা চিকিৎসায় বা অল্প চিকিৎসায় ভালো হয়ে যাবে। বাকিরা হয়তো কিছুটা বা অনেকটা জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করবে। আমরা কেউই অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারব না। তাই করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকলেও তা বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক হওয়া দরকার এবং মানুষ হিসেবে আমাদের আচার-আচরণের একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রা রাখা দরকার। অন্যদিকে অজ্ঞতাবশত অতি সাবধানী হয়ে আজ যে অমানবিক আচরণ আপনি করছেন বা আরেকজন করছে, আপনি নির্বাক হয়ে দেখছেন, করোনা আক্রান্ত হলে তা একদিন আপনার ওপর চলে আসতে পারে। সেদিন আপনি কী করবেন? একবার ভাবুন, আপনি যদি অতি সাবধানী হয়ে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর প্রতি এতটা অমানবিক আচরণ করেন তাহলে চিকিৎসক কেন আপনার চিকিৎসা দেবেন? তারও জীবনের প্রতি মায়া আছে, তারও পরিবার-পরিজন আছে। তাই আমাদের সবার উচিত দায়িত্ববোধসম্পন্ন মানুষের মতো আচরণ করা, সবার প্রতি মানবিক আচরণ করা। সুশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মধ্যে চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, সহানুভূতি-মহানুভবতার পার্থক্য সৃষ্টি করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
এ কে এম জাকারিয়া: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।।