জুন ২৬, ২০২০
নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ টার্মটিও ভাইরাসের মতো দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এর ব্যবহার ভুল ধারণায় পরিপূর্ণ। যুক্তরাজ্য হার্ড ইমিউনিটিকে কৌশল হিসেবে নিয়েছিল জনগণের সবচেয়ে দুর্বল অংশকে রক্ষা করার জন্য। মূলত অন্যদের আক্রান্ত হতে উৎসাহিত করে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি অর্জনের মাধ্যমে এটা করতে চেয়েছিল তারা। অনেকেই আবার হার্ড ইমিউনিটি থেকে আমরা আসলে কতদূরে আছি সে বিষয়টিকেও আলাপে নিয়ে আসে। তবে ভ্যাকসিন ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের এ কৌশল মহামারীর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে।
তবে আমাদের এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে হার্ড ইমিউনিটি আসলে কী, কখন এটি কার্যকর কৌশল এবং কেন। ভ্যাকসিন ছাড়া এটি যে মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারে না, সেটিও বুঝতে হবে।
হার্ড ইমিউনিটি কী?
এপিডেমিওলজিস্টরা ভাইরাসের জন্য প্রদত্ত হার্ড ইমিউনিটিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, জনগণের একটা অংশ নিশ্চিতভাবে ইমিউন হবে এটা নিশ্চিত করার জন্য যে এর ফলে কোনো প্রাদুর্ভাবের সৃষ্টি হবে না। অর্থাৎ যদি যথেষ্ট পরিমাণ মানুষ ইমিউন হয়ে যায়, তবে আক্রান্ত ব্যক্তি এরই মধ্যে ইমিউন হয়ে যাওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেও তাকে আক্রান্ত করতে পারবে না। কেবল যারা তখনো সংবেদনশীল তাদের মাঝেই ভাইরাস সীমাবদ্ধ থাকবে।
হার্ড ইমিউনিটিকে সাধারণত ভ্যাকসিনেশনের আলোকে বিবেচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ যদি ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা চিকেন পক্সের ভ্যাকসিন গ্রহণ করে, তখন বাকি ১০ শতাংশ যেমন শিশু বা যারা ইমিউন অযোগ্য তাদের মাঝেই রোগ সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে সার্স-কোভ-২-এর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটির বিষয়টি বেশ আলাদা। এক্ষেত্রে বেশকিছু ব্যাপার ভাবতে হবে।
১. আমাদের হাতে ভ্যাকসিন নেই। বায়োলজিস্ট কার্ল বার্গস্ট্রোম এবং বায়োটেকনিশিয়ান নাটালি ডিন মে মাসে নিউইয়র্ক টাইমসে যেমনটা বলেছিলেন, বিস্তৃত পরিসরে ভ্যাকসিন ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি পেতে হলে ৬০ থেকে ৮৫ শতাংশ লোককে সংক্রমিত হতে হবে এবং ভাইরাসের উচ্চমৃত্যুর হার বলছে এর ফলে লাখ লাখ মানুষ মারা পড়বে।
২. ভাইরাসকে এখনো থামানো যায়নি। যদি মহামারী চলাকালে হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হতে হয়, তবে দেখা যাবে অধিকসংখ্যক সংক্রমিত ব্যক্তি ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে শেষ পর্যন্ত হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে গিয়ে অনেক মানুষ সংক্রমিত হবে। সেটা হতে পারে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত।
জীবন হারাতে হবে
ভাইরাসে যেকোনো ব্যক্তি হয় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল, বর্তমানে আক্রান্ত অথবা সংক্রমিত হওয়া থেকে সুরক্ষিত। যদি ভ্যাকসিন পাওয়া যায় তবে সংবেদনশীল ব্যক্তিও ইমিউন হতে পারেন, আক্রান্ত না হয়েও।
আর ভ্যাকসিন ছাড়া ইমিউন হওয়ার একমাত্র উপায় সংক্রমিত হওয়া। তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে সার্স কোভ-২-এর সংক্রমণে প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে।
ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে প্রতিদিন বিশ্বের অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। যারা বেঁচে যাবে তাদের জন্যও এই ভাইরাস দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। তার ওপর বিজ্ঞানীরা এখনো জানেনই না যারা সেরে উঠছে তারা আদৌ ভবিষ্যৎ সংক্রমণ থেকে ইমিউন কিনা। তাই ভ্যাকসিনই পারে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে সরাসরি ইমিউনিটি তৈরির উপায়।
বিস্তার সীমিত হচ্ছে না
হার্ড ইমিউনিটি না আসা পর্যন্ত মহামারীর বিস্তার থামছে না। কিন্তু যখন মহামারী চলাকালে হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হবে তখন প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এমনিতেই কমে আসবে। তবে সেই পর্যায়ে যথেষ্ট পরিমাণের সংক্রামক ব্যক্তি ভাইরাসের বিস্তৃতি অব্যাহত রাখতে পারবে। বার্গস্ট্রোম এবং ডিন যেমনটা বলেছিলেন, একটি লাইনচ্যুত ট্রেন যেমন তাত্ক্ষণিকভাবে থেমে যায় না, তেমনি হার্ড ইমিউনিটি চলে আসার পরও দ্রুতগতিতে বিস্তৃত হতে থাকা ভাইরাস তার সংক্রমণ থামিয়ে দেয় না।
যদি ভাইরাসকে থামানো না যায় তবে আক্রান্তের চূড়ান্ত সংখ্যা হার্ড ইমিউনিটির লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে অনেক বেশি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে কভিড-১৯-এ জনসংখ্যার মাঝে আক্রান্তের সংখ্যা হতে পারে শতকরা ৯০ শতাংশ। তবে সুরক্ষাকবচ যেমন সামাজিক দূরত্ব এবং মাস্ক পরিধান করে ভাইরাসের বিস্তৃতি হ্রাস করা যেতে পারে, কমানো যেতে পারে নতুন আক্রান্তের সংখ্যাও।
দুর্বলদের রক্ষা করতে পারবে না
যেসব মানুষ কভিড-১৯-এর মোকাবেলার ক্ষেত্রে বেশি দুর্বল, যেমন যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং সংক্রমণ এড়াতে বাসায় অবস্থান করতে হয়; যাই হোক, এসব মানুষের অনেকে একই সমাজের মধ্যে বাস করে এবং সেখানকার মানুষের সঙ্গে সামাজিকীকরণ হয়।
এখন হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হলেও যদি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি এসব দুর্বল অংশের মানুষের সংস্পর্শে আসে তবে তা বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। করোনাভাইরাস নার্সিং হোমগুলোকেও ধসিয়ে দিয়েছে। ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত এটি চলতে থাকবে।
সব মিলিয়ে ভ্যাকসিন ছাড়া আমাদের কোনোভাবেই হার্ড ইমিউনিটিকে শেষ সম্বল হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। নয়তো অনেক মানুষের মৃত্যু হবে এবং দুর্বলদের রক্ষা করা যাবে না। আপাতত হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাই সেরা উপায়। চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত এতেই ভরসা রাখতে হবে।
স্ক্রলডটইন