• ঢাকা
  • শনিবার, ২৮শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই মে, ২০২৪ ইং
ফরিদপুরে লোকসানে ডুবতে বসেছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া চিনি কল

এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর >>

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড। ১৯৭৪ সালে মিলটি প্রতিষ্ঠিত। মিলটির বয়স ৪৬ বছর। এটি ফরিদপুর জেলার একমাত্র ভারী কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, মোট ৪৬টি মাড়াই মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১৩টি মৌসুম লাভের মুখ দেখে চিনিকলটি। বাকি ৩৩টি মাড়াই মৌসুমে লোকসানে পড়তে হয়। জরাজীর্ণ মেশিন, আখের ভালো জাতের অভাব, শুধু চিনি উৎপাদনে নির্ভরশীলতা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ডুবতে বসেছে মিলটি।

মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নে ১২৯ দশমিক ৯৭ একর জমির ওপর কারখানাটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের আওতাধীন কারখানাটি ৩৫০ কোটি টাকার অধিক লোকসানে রয়েছে। মিলের অধিকাংশ মেশিনারিজের কার্যক্ষমতা কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে মিলের সব ধরনের মেশিন ও যন্ত্রপাতি। পুরোনো মেশিন ও যন্ত্রাংশ পরিবর্তন এবং প্রতিস্থাপন করে আধুনিকায়নের মাধ্যমে মিলের কার্যক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করে মিল কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানি করা হয় চিনি উৎপাদনের যন্ত্রপাতি। এ কারখানাটি নির্মাণে ব্যয় হয় আট কোটি ২৮ লাখ টাকা। ১৯৭৪ সালে মিলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় চিনি উৎপাদন। ১৯৭৭ সালের ২ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্টের শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন মিলটির উদ্বোধন করেন।

ফরিদপুর চিনি কল লিমিটেড বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এটি দেশের অন্যতম প্রধান চিনি কল। এখানে চিনি, জৈব সার, চিটাগুড়, মণ্ড উৎপাদন করা হয়। সুগার মিলটির মাড়াই ক্ষমতা প্রতিদিন এক হাজার ১৬ মেট্রিক টন। তবে আখের অভাবে মিলটি বছরের ১২ মাসের মধ্যে এক মাস ১০ দিন চালু থাকলেও বাকি সময় থাকে বন্ধ। এ পর্যন্ত ৪৫ মাড়াই মৌসুমের মধ্যে লাভের মুখ দেখে ১৩ মৌসুম। লোকসান হয় ৩৩ মৌসুমে।

সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে আখ মাড়াই শুরু হয় ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এটি ৪৬তম মৌসুমের আখ মাড়াই। ৪০ কার্যদিবসে ৪১ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুই হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ আখমাড়াই মৌসুমে মিলটি ১০৩ কার্যদিবসে এক লাখ আট হাজার ৪২৩ টন আখ মাড়াই করে আট হাজার ১৩১ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছিল শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ। সেই মৌসুমে মিলটি ৭০ কোটি ৩৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়।

২০১৯-২০ অর্থবছর ৪২৮ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় ছিল মিলটির। ওই মৌসুমে ১০ হাজার একর জমিতে আখ রোপণ করা হয়। ৭৭ কার্যদিবসে মোট ৭৮ হাজার টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয় শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ।

২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চিনিকলের প্রায় ৩৪৬ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন চিনি অবিক্রীত অবস্থায় গুদামে পড়ে রয়েছে। চিনিকলটির নিজস্ব উৎপাদিত চিনির পাইকারি বিক্রয় মূল্য সর্বশেষ কেজিপ্রতি ৭৪ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছর চার হাজার ৪৩৩ চাষির মাঝে তিন কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে মিল কর্তৃপক্ষ।

আখের অপর্যাপ্ত সরবরাহ চিনিকলটি মাড়াই মৌসুমজুড়ে আখ থেকে চিনি উৎপাদনের পর্যাপ্ত আখ পায় না। তাই বছরের একটা বড় সময়জুড়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে। যদিও বাজারজাতকরণ, বিতরণ, যন্ত্রাংশ মেরামত, লেনদেন ও ব্যবস্থাপনার কাজ পুরো বছরই চলে কিন্তু পণ্য বহুমুখীকরণ (অ্যালকোহল, স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক, বায়োগ্যাস, জৈবসার, বর্জ্য ছোবড়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন) না করায় সরাসরি উৎপাদনে জড়িত শ্রমিক, কর্মচারীরা পুরো বছর কাজের সুযোগ পান না। কিন্তু বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন খরচ বহন করতে হয় কর্তৃপক্ষকে।

মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণ
খরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায় না, চিনিকলে সময়মতো আখ বিক্রি করা যায় না, বিক্রি করলেও সময়মতো অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষ করছেন। যারা আখ চাষ করছেন তারা চিনিকলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রি করছেন। ভালো মানের আখ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা নেই। অর্থাৎ সব গ্রেডের আখের দাম একই। এতে মান বাড়ানো নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ দেখা যায় না।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকার একাধিক কৃষকরা বলেন, আমরা আগে আখ চাষ করতাম। আখ চাষ করে লাভ হয় না। আখের জাত ভালো নয়। মানুষের অত্যাচার বেশি, তাই আখ চাষ বাদ দিয়েছি। এখন অন্য ফসল চাষ করি। তবে আখ চাষে লাভ হলে, সুযোগ সুবিধা পেলে আবার আখ চাষ করবো বলে জানান তিনি।

সুগার মিলের শ্রমজীবী ইউনিয়নের সাবেক সহ-সভাপতি ও জুনিয়র কার্বাইন অপারেটর (যান্ত্রিক বিভাগ) মেহেরাব হোসেন উজ্জ্বল বলেন, সুগার মিলটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। এ এলাকার একটি ঐতিহ্য। এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবনমান, জীবিকা ও ভাগ্য জড়িয়ে আছে। মিলটি লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করে বাঁচিয়ে রাখতে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি বায়োপ্রডাক্ট বাড়াতে হবে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, কর্মসূচি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।

মিলটি লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে তাদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বলে দাবি করেন শ্রমজীবী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজল বসু। তিনি বলেন, ফরিদপুর সুগার মিলটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে মিলটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৯০০ জন। মোট ৪ হাজার ৮৯২ জন আখচাষি রয়েছেন চিনিকলে। কারখানাটি পুনরায় লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পাশাপাশি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ফরিদপুর সুগার মিলের (যান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বে) উপ-ব্যবস্থাপক (যন্ত্র কৌশল) মো. রাজু আহম্মেদ বলেন, ১৯৭৬ সালে মিলটিতে মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়। সে হিসেবে এর বয়স ৪৬ বছর।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।