• ঢাকা
  • শুক্রবার, ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই মে, ২০২৪ ইং
স্বাস্থ্য বিভাগের ডিজি, করোনা ২-৩ বছর থাকবে, এ বক্তব্যর সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা

দেশে করোনা পরিস্থিতি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশিদিন স্থায়ী হবে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের এমন বক্তব্যে করোনা নিয়ে দেশে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদি তা-ই হয়, তা হলে মানুষ কী করবে, কিংবা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিই-বা কোনদিকে যাবে, এ নিয়ে নানা মহলে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ঘরবন্দি মানুষ নিজেদের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে এবং করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মানুষ ঠিক কোনপথে যাবে, এ নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অবশ্য মহাপরিচালকের এই বক্তব্যকে ‘তার নিজের বক্তব্য’ এবং এই বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
গতকাল রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মহাপরিচালকের বক্তব্যের একটি অংশের সংশোধনী দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য বিভাগের এমন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এমন বক্তব্যে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হবে বলেও মনে করেন তারা। এমনকি এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা ফুটে উঠল বলেও মনে করছেন তারা।
এ ব্যাপারে দেশে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, তার (মহাপরিচালক) বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এটা তার একক বক্তব্য। আমরা যদি করোনাকে থাকতে বলি, থাকবে। আমরা যদি থাকতে না বলি, থাকবে না। আমরা চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। আমরা যদি কোনোকিছু না করি, তাহলে তিন বছর কেন, আরও বেশি থাকবে।
যতদিন না হার্ড ইমিউনিটি হয়, ততদিন থাকবে। আমরা যদি কিছুই না করি, তা হলে সংক্রমণ কি এমনি এমনি কমবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধানের এমন বক্তব্যে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হলো বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
একইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, এটার (মহাপরিচালকের বক্তব্য) কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তো অবশ্যই নেই। কারণ আমরা যদি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা নিই, সঠিক পন্থা অবলম্বন করি এবং সঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিই, তাহলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব এবং এতে যে মৃত্যুঝুঁকি সেটাও কমানো সম্ভব। এটার জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক বেশি ছড়িয়েছিল। অনেক মৃত্যুও হয়েছে তাদের। কিন্তু কিছু দেশ বিলম্বে হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক বেশি। আবার অনেক দেশ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরফলে অনেক দেশ ইতিমধ্যেই করোনামুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে এশিয়ার দেশ পূর্ব তিমুর ও এশিয়ার বাইরে নিউজিল্যান্ড। এ ছাড়া ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এই দেশগুলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেছে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে। এসব দেশ একইভাবে মৃত্যুঝুঁকিও কমিয়েছে। অথচ আমরা প্রথম দিকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিইনি। পাশাপাশি যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটাও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা সচেতনতার ওপরই নির্ভর করেছি। কিন্তু জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে পারিনি।
এমনকি এই বিশেষজ্ঞ এমনও বলেন, এখন থেকেও সবকিছু যদি সঠিকভাবে সঠিক সময়ে করতে পারি, তাহলে সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু সব কাজ সঠিকভাবে করতে হবে। সবুজ, লাল ও হলুদ যে জোন ভাগ করা দরকার, সেটা জেলাওয়ারী ভাগ করবে এবং সেই দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা থাকবে সিভিল সার্জনের, সহযোগিতা লাগবে ডিসি ও এসপির। শুধু লাল জোনে না, প্রতিটি জোনেই জনগোষ্ঠীকে টেস্ট করতে হবে। সংক্রমিত লোকদের আলাদা করতে হবে। যারা সংস্পর্শে আসবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। আর উপজেলা থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হলো বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা ও ব্যর্থতা ফুটে উঠল। তিনি বলেন, এ ধরনের বক্তব্য কোনো দেশ এরকমভাবে দেয় না। এটা এমন হতে পারে আমাদের করোনা থাকবে। করোনা তো একেবারে চলে যাবে না। আমাদের এই পর্যন্ত যে ভাইরাসগুলো এসেছে, সেগুলো সব একদম চলে যায়নি। এটাও যাবে না। কিন্তু অন্য ভাইরাসের সঙ্গে এই ভাইরাসের একটা পার্থক্য আছে। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষের ভূমিকাটা মুখ্য। কারণ এই ভাইরাস নিজে নিজে বড় হয় না। এটার জীবন নেই। এটা আমাদের শরীরে প্রবেশ করলেই সমস্যা। সুতরাং এখানে জনগণের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি সরকারের সঠিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি থাকতে হবে। এর মধ্যে তিনটা হলো টেস্ট, কন্টাক্ট ট্রেসিং ও ট্রিটমেন্ট। যেসব দেশ এই তিনটা জিনিস ভালো করবে, তারাই সফলকাম হবে। সুতরাং আমাদের আশাবাদী হতে অসুবিধা কোথায়? আমরা যদি সঠিকভাবে সবকিছু পালন করি তা হলেই তো পারি।
বেশ কিছুদিন অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে অনুপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক। গতকাল প্রথম তিনি বুলেটিনে যুক্ত হন। বুলেটিনের শুরুতেই মহাপরিচালক বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি এক, দুই বা তিন মাসে শেষ হচ্ছে না। এটি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশিদিন স্থায়ী হবে। যদিও সংক্রমণের মাত্রা উচ্চহারে নাও থাকতে পারে।
ডা. আজাদ বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুকাল পরে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের উচ্চহার কমে আসতে পারে। কিন্তু পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ালে অনেক লুকায়িত এবং মৃদু কেইসও (রোগী) শনাক্ত হবে। সেক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যার পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর নাও হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সম্যক উপলব্ধি করেছেন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে অধিকতর জোরালো নজর দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। এরপর তিনি চিকিৎসা ও পরীক্ষাসহ করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন।
মহাপরিচালকের এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ড. মোজাহেরুল হক আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়েছে, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একই সঙ্গে লকডাউনের আওতায় আনা। লকডাউনে যাওয়ার আগে সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা, যাতে এটা সফল হয়। মনে রাখতে হবে, এখনো আমরা সংক্রমণের হার অনুযায়ী তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনদের কোয়ারেন্টাইনে নিচ্ছি না। সুতরাং আমরা যদি সঠিকভাবে সঠিক সংখ্যায় কঠোরভাবে তাদের কোয়ারেন্টাইনে নিতে না পারি, তা হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।
পাশাপাশি টেস্টের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এখন শুধু আর পিসিআর টেস্টের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করতে হবে। আর আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা জরুরিভিত্তিতে বাড়াতে হবে। তাহলেই আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব ও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পারব।
ডিজির বক্তব্যের সংশোধনী : গতকাল রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মহাপরিচালকের বক্তব্যের একটি অংশের সংশোধনী দেওয়া হয়। মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় এবং বিশ্বের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতি এক-দুই বা তিন মাসে শেষ হচ্ছে না। এটি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়ে বেশি স্থায়ী হবে। যদিও আমরা মনে করি, সংক্রমণের মাত্রা অনেক হ্রাস পাবে। ’ সেখানে সংশোধনী হিসেবে ‘এক-দুই বা তিন মাসে শেষ হচ্ছে না’-এর পর নতুন করে সংযুক্ত করা হয়, ‘একটি সফল টিকা আবিষ্কার এবং পর্যাপ্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সফল প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত দেশগুলোতে করোনার অস্তিত্ব থাকবে। ফলে এটি এক বছরের বেশি এমনকি দুই বা তিন বছর।

ফেসবুকে লাইক দিন

তারিখ অনুযায়ী খবর

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।