জুন ২৭, ২০২০
কভিড-১৯ মোকাবেলায় সম্ভাব্য সর্বোচ্চসংখ্যক নমুনা পরীক্ষায় জোর দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন মহল। পিসিআর টেস্টের পাশাপাশি তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় সর্বোচ্চসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা নিশ্চিত করতে অ্যান্টিবডি টেস্টকেও এখন সমান গুরুত্বের চোখে দেখছে উন্নত দেশগুলো।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত মাধ্যম হলো পিসিআর টেস্ট। দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তের জন্য এটি কার্যকর। এক্ষেত্রে সংগৃহীত নমুনায় ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল ‘আরএনএ’ রয়েছে কিনা সেটি পিসিআরের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। কারো শরীরে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছিল কিনা, সেটি নিশ্চিত করা যায় অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে। সাধারণত সংক্রমণের সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে দেহে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি তৈরির আগে এ টেস্টের মাধ্যমে কেউ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিল কিনা, সেটি জানা যাবে না। নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের বড় একটি অংশের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। যদিও উপসর্গমুক্ত এ সংক্রমিতরাও উপসর্গযুক্তদের মতোই বেশ দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ছড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপসর্গ প্রকাশ না পেলে মানুষ পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করাতে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। উপসর্গমুক্ত রোগীদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে সংক্রমণের ব্যাপ্তির প্রকৃত চিত্র অনুধাবনের জন্যও এটি কার্যকর। এছাড়া সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে সর্বত্রই জনসাধারণের চলাচলে একধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে অনেকেই আয়হীন হয়ে পড়বে। লকডাউন দীর্ঘস্থায়ী হলে আরো নানা সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাপক ভিত্তিতে ব্যয়সাশ্রয়ী অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে এরই মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছে, তাদের কাজে যোগদানের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
এছাড়া একবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার নজিরও রয়েছে অনেক। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে যেহেতু অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়, তাই দ্বিতীয়বার সংক্রমণের ক্ষেত্রে এটি জটিল আকার ধারণ করবে না বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এ অ্যান্টিবডি শরীরে কতদিন কার্যকর থাকে, সেটি নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। বর্তমানে একই ব্যক্তির একাধিকবার সংক্রমণ ও অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা নিয়ে অনেক গবেষণা চলমান রয়েছে। সামনের দিনগুলোয় এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ব্যয়সাশ্রয়ী ও সহজে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এরই মধ্যে অনেকগুলো অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। আরো অনেকগুলো কিট অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়া গবেষণাগারে উন্নয়নমূলক পর্যায়েও রয়েছে অনেক কিট।
চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ এরই মধ্যে এ নীতি অনুসরণের মাধ্যমে বেশ সফলতা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির তথ্যানুসারে, দেশটিতে এরই মধ্যে সেলেক্স, কেমবায়ো, অর্থো ক্লিনিক্যাল, মাউন্ট সিনাই ল্যাবরেটরি, অটোবায়ো, ডায়াসরিন, অ্যাবট, বায়োরাড, রোশে, ইউরোইমান, ওয়াডসর্থ, হিলজেন সায়েন্টিফিক, সিমেন্স হেলথকেয়ার, ভাইব্র্যান্ট আমেরিকা, হ্যানজো বায়োটেস্ট বায়োটেক, ইনবায়োস ইন্টারন্যাশনাল নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট পরীক্ষার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এছাড়া চীনের অটো বায়োসায়েন্স, ওরিয়েন্ট জিন বায়োটেক, স্ক্যানওয়েল হেলথ, যুক্তরাজ্যে এডিনবরা জেনেটিকস, সিঙ্গাপুরে ওয়াং ল্যাব, সুইজারল্যান্ডে কুইটেন্ট এবং মেক্সিকো ও ব্রাজিলে কাবলা ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিকের কিটের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের কলকাতায়ও এখন অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
অ্যান্টিবডি টেস্টের বিষয়ে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ হলো অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি এসব কিটের কার্যকারিতার বিষয়ে স্বতন্ত্র সংস্থার প্রতিবেদন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যান্টিবডি টেস্ট করছে, তাদের পর্যবেক্ষণগুলোও কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
দেশে কভিড-১৯-এ আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্লাজমা থেরাপি ব্যবহূত হচ্ছে। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি কার্যকর প্রভাব রাখছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এটি কার্যকর হয়নি। এক্ষেত্রে প্লাজমা নেয়ার আগে অ্যান্টিবডি টেস্ট করে নেয়া হলে সেটি কার্যকর হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে বর্তমানে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এএম শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীকে প্লাজমা দেয়ার আগে এতে অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব ১ঃ১৬০-এর কম হলে সেটি কোনো কাজে আসবে না। আর অ্যান্টিবডি কিটের মাধ্যমে প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্বের পরিমাণ জানা যায়। তাছাড়া কী পরিমাণ মানুষ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত বা অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা কতদিন পর্যন্ত শরীরে থাকে, সেটি বোঝার জন্যও অ্যান্টিবডি টেস্টের প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে রোশে, অ্যাবট, সিমেন্সের মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হলে প্লাজমা থেরাপি আরো কার্যকর হবে বলে মনে করছেন তিনি।
দেশে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রথম প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজির অধ্যাপক ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের এখানে যেহেতু পিসিআর টেস্ট কম হচ্ছে তাই অ্যান্টিবডি টেস্ট করা উচিত। অনেক সন্দেহভাজন রোগী টেস্ট না করেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। টেস্ট করানোর জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। আবার একই পরিবারে সব সদস্যের পিসিআর টেস্ট করাতে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় কম খরচে ও সহজে কেউ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিল কিনা সেটি জানতে, অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যেতে পারে। ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটির পক্ষ থেকেও সরকারকে অ্যান্টিবডি টেস্ট করানোর বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেয়ার ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবডি টেস্ট করানোর প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় প্লাজমা থেরাপি দেয়ার আগে অ্যান্টিবডি টেস্ট করানোটা বাধ্যতামূলক। প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরিমাপ করে চিকিৎসা দেয়ার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ থেরাপির কার্যকারিতা বেশ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু আমাদের দেশে প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরিমাপের অনুমোদন নেই। এ কারণে কভিড-১৯-এ আক্রান্তদের প্লাজমা থেরাপি দেয়ার সময় এর কার্যকারিতা কতটুকু, সেটি বোঝা যায় না। কারণ প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব ১ঃ১৬০-এর কম হলে সেটি আক্রান্ত রোগীকে দেয়া হলেও কোনো কাজে আসবে না। তাই দেশে অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করা প্রয়োজন।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের কভিড ইউনিটের চিকিৎসক ও ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. দীপঙ্কর কুমার বসাক বণিক বার্তাকে জানান, প্লাজমা চিকিৎসায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরিমাপের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের হাসপাতালে প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরিমাপ করার পরই সেটি কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীকে দেয়া হচ্ছে। প্লাজমায় অ্যান্টিবডি না থাকলে কিংবা পরিমাণে কম থাকলে সেটি কার্যকর হবে না। এখন পর্যন্ত আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে, রোগীকে যত আগে প্লাজমা থেরাপি দেয়া যায়, সেটি তত বেশি কার্যকর হয়। সরকারের পক্ষ থেকে অ্যান্টিবডি টেস্টের বিষয়ে কোনো অনুমোদন বা নির্দেশনা না থাকলেও রোগীদের প্রয়োজনে আমরা প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরিমাপ করে তারপর রোগীকে দিচ্ছি। চিকিৎসার সুবিধার্থেই এটিকে অনুমোদন দেয়া উচিত।
বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য আরএনএ বায়োটেক লিমিটেডও র্যাপিড ডট ব্লট নামে একটি অ্যান্টিবডি কিট তৈরি করেছে। যদিও এটি এখনো সরকারের অনুমোদন পায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এরই মধ্যে কিটটির কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছে। পরীক্ষা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান, কিটটি উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের রোগ শনাক্তকরণে কার্যকর নয়। তবে এ কিটের মাধ্যমে ৭০ শতাংশ রোগী, যারা আগে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিল তাদের শনাক্ত করা সম্ভব। কিটটি কভিড-১৯-এর ব্যাপ্তি দেখার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।