‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর।’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ৪৩)।
জাকাত ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত। প্রত্যেক মুসলমানকে যেমন জাকাত ফরজ হওয়ার বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে যার ওপর জাকাত ফরজ তাকে তা নিয়মিত পরিশোধও করতে হবে।
আবি আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে ওমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) থেকে শুনেছি যে, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এতে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা, জাকাত দেয়া, শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকলে হজ করা এবং রমজান মাসে রোজা রাখা।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
জাকাত ফরজ হওয়ার দলীল :
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاء وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ
‘তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা নিবিষ্ট মনে একান্তভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে, যথাযথভাবে সালাত আদায় করবে, জাকাত প্রদান করবে, আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। ’ (সূরা : বাইয়্যিনাহ, আয়াত : ৫)।
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُون
‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎ কাজ করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং জাকাত প্রদান করেছে, তাদের জন্য পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নাই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (সূরা : বাক্বারা, আয়াত : ২৭৭)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
وَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ وَآتُواْ الزَّكَاةَ وَارْكَعُواْ مَعَ الرَّاكِعِينَ
‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু কর।’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ৪৩)।
জাকাত বলতে বুঝায়:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلاَتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘হে নবী! তাদরে (ধনীদরে) ধন সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদরেকে পাক পবত্রি করো, (নেকীর পথে) তাদরেকে এগিয়ে দাও এবং তাদরে জন্য রহমতের দোয়া করো। তোমার দোয়া তাদরে সান্তনার কারণ হবে। আল্লাহ সবকছিু শুনেন ও জানেন।’ (সূরা: তাওবা, আয়াত: ১০৩)।
জাকাতের শাব্দিক অর্থ: পবিত্রতা, বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধি, বরকত। কারণ যিনি জাকাত প্রদান করবেন, তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে উহা বালা-মুছিবত থেকে রক্ষা পাবে। ইবনে তাইমিয়া হতে বর্ণিত, ‘জাকাতপ্রদানকারীর মন পবিত্র হয় এবং তার সম্পদে বরকত হয় ও বৃদ্ধি পায়।’
যাদের ওপর জাকাত ফরজ: নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর ওপর জাকাত প্রদান করা ফরজ। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসেবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার ওপর পূর্ববর্তী বছরের জাকাত প্রদান করা ফরজ। অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি জাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে। জাকাত ফরজ হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি জাকাত প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের জাকাত দিতে হবে।
জাকাতের নিসাব: রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যেকোনো একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে যাকাতের নিসাব বলে।
কোনো ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চন্দ্র মাসের হিসেবে এক বৎসর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে তাহলে তার ওপর এ সম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত রূপে প্রদান করা ফরজ। মনে রাখতে হবে বছরের শুরু ও শেষে এ নিসাব বিদ্যমান থাকা জরুরি। বছরের মাঝখানে এ নিসাব পূর্ণ না থাকলেও জাকাত প্রদান করতে হবে। সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের ওপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নিসাব পরিমাণের ওপর বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। অতএব, বছরের শুরুতে শুধু নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলেও বছরের শেষে যদি সম্পদের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে ওই বেশি পরিমাণের ওপর জাকাত প্রদান করতে হবে। বছরের যে কোন অংশে অধিক সম্পদ যোগ হলে তা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। জাকাত ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে মূল নিসাবের ওপর বছর অতিক্রম করা শর্ত। জাকাত, জাকাতুল ফিতর, কোরবানি এবং হজ এ সব শরীয়তের বিধান সম্পদের মালিকানার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
জাকাত বহির্ভুত সম্পদ: জমি, বাড়ী-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ী, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি, যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ী, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহ-পালিত পাখি, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির জাকাত হয় না। ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত অর্থের ওপর জাকাত হয় না। শস্য ও গবাদি পশুর জাকাত পরিশোধ করার পর ওই শস্য বা গবাদি পশু বিক্রিকরে নগদ অর্থ প্রাপ্ত হলে ওই প্রাপ্ত অর্থের ওপর একই বছরে জাকাত দিতে হবে না। কারণ একই সম্পদের একই বছরে দুইবার জাকাত হয় না।
যেসব সম্পদের জাকাত ফরজ: (১) স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ (২) বানিজ্যিক পণ্য (৩) মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু (৪) শস্য ও ফলমূল।
স্বর্ণ ও রূপার জাকাত: যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ ভরি (১ভরি=১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) রূপা থাকে তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলংকার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত, স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত যেকোনো বস্তু, সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার জাকাত ফরজ। হীরা, ডায়মন্ড, হোয়াইট গোল্ড, প্লাটিনাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু যদি সম্পদ হিসেবে বা টাকা আটকানোর উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাহলে বাজার মূল্য হিসাবে তার জাকাত দিতে হবে। অলংকারসহ সর্ব প্রকার স্বর্ণ-রূপার জাকাত দিতে হবে।
নগদ অর্থের জাকাত: নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোষ্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মূদ্রা (নগদ, এফসি একাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোষ্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কীম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের জাকাত প্রতি বছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে। প্রতিষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী বাধ্যতামুলকভাবে চাকরিজীবির বেতনের একটি অংশ নির্দ্দিষ্ট হারে কর্তণ করে ভবিষ্য তহবিলে জমা করা হলে ওই অর্থের ওপর জাকাত ধার্য হবে না, কারণ ওই অর্থের ওপর চাকরিজীবির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ ফেরৎ পাওয়ার পর জাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ঐচ্ছিকভাবে (অপ্শনাল) ভবিষ্যৎ তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে তার ওপর জাকাত প্রযোজ্য হবে অথবা বাধ্যতামূলক হারের চাইতে বেশি হারে এই তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে ওই অতিরিক্ত জমা অর্থের ওপর বছরান্তে জাকাত প্রযোজ্য হবে। চাকুরীজীবির অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে এই অর্থ যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে জাকাত প্রদান করতে হবে। পেনশনের টাকাও হাতে পেলে জাকাত হিসাবে আসবে। মানড়বত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মোহরের জমাকৃত টাকা, হজ ও কোরবানির জন্য জমাকৃত টাকার ওপরেও বছরান্তে যথানিয়মে জাকাত দিতে হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) ওপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ কোনো জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের ওপর জাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার ওপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ওই মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে জাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার ওপর জাকাত: জাকাত প্রদানের সময় উপস্থিত হলে মালিকানাধীন সব বৈদেশিক মুদ্রার নগদ, ব্যাংকে জমা, টিসি, বন্ড, সিকিউরিটি ইত্যাদি জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির বসবাসের দেশের মুদ্রাবাজারে বিদ্যমান বিনিময় হারে মূল্য নির্ধারণ করে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করে জাকাত প্রদান করতে হবে।
মোহরাণার অর্থের ওপর জাকাত: ‘মোহর’ বিধানের মাধ্যমে ইসলাম নারীদের জন্য এক অনন্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। কনে, বরের সঙ্গে তার বিবাহবন্ধনে স্বীকৃতির সম্মানীস্বরূপ, বরের কাছ থেকে মোহর (মোহরাণা) পেয়ে থাকে। মোহর বাবদ প্রাপ্ত জমাকৃত অর্থের ওপর জাকাত ধার্য হবে। মোহরের অর্থ নিসাব মাত্রার হলে অথবা অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে জাকাত প্রদান করতে হবে। মোহরাণার যে অর্থ আদায় করা হয়নি তার ওপর জাকাত ধার্য হবে না, কারণ এই অর্থ তার আওতাধীনে নাই। প্রচলিত মুদ্রায় (টাকায়) ধার্যকৃত ’মোহর’ বিয়ের সময় সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ না করে, বিলম্বে প্রদান করা হলে তা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। বর্তমানকালে বিদ্যমান মুদ্রার ক্রমবর্ধমান মূল্যহ্রাসের ফলে এই পাওনা পরবর্তীতে যখন পরিশোধ করা হয়, তখন মোহরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ একান্ত নগণ্য বা তুচ্ছ পরিমাণ হয়ে যায়। শরীয়াহ বিশারা এই সমস্যার সমাধানে দৃঢ় মত পোষণ করেন যে, প্রচলিত মূদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে ‘মোহর’ নির্ধারণ করা উচিত, যাতে করে বিবাহিত নারীদের এই অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং পরবর্তীকালে প্রচলিত মুদ্রার মূল্যহ্রাসজনিত কারণে তাদের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
শেয়ার এর ওপর জাকাত: যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনকে সমমূল্য বিশিষ্ট বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করা হয়। এরূপ ক্ষুদ্রাংশগুলোকে শেয়ার বলে। শেয়ার মালিককে কোম্পানির নিট সম্পত্তির একজন অংশীদার হিসেবে গণ্য করা হয়। শেয়ার ক্রয়ের উদ্দেশ্য বৃহৎ কোম্পানির ব্যবসায় বিনিয়োগ, কোম্পানির আংশিক মালিকানা অর্জন এবং লভ্যাংশ বা মুনাফা উপার্জন করা। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ যেমন- অসামাজিক বা অনৈতিক ব্যবসায়ে লিপ্ত, নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় বা সুদী কারবার ও দৈবনির্ভর লেনদেনে নিয়োজিত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় বৈধ নয়। কোম্পানি নিজেই যদি শেয়ারের ওপর জাকাত প্রদান করে তা হলে শেয়ারমালিককে তার মালিকানাধীন শেয়ারের ওপর জাকাত দিতে হবে না। কোম্পানি জাকাত প্রদান করতে পারবে যদি কোম্পানির উপ-বিধিতে এর উল্লেখ থাকে অথবা কোম্পানির সাধারণ সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অথবা শেয়ারমালিকরা কোম্পানিকে জাকাত প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেন।
কোম্পানি নিজে তার শেয়ারের ওপর জাকাত প্রদান না করলে শেয়ার মালিককে নিম্নোক্ত উপায়ে জাকাত প্রদান করতে হবে-
(১) শেয়ারমালিক যদি শেয়ারগুলো বার্ষিক লভ্যাংশ অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করে, তা হলে জাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত উপায়ে নির্ণয় করা হবে: (ক) শেয়ারমালিক যদি কোম্পানির হিসাবপত্র যাচাই করে তার মালিকানাধীন শেয়ারের বিপরীতে জাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেন, তাহলে তিনি ২.৫% হারে জাকাত প্রদান করবেন। (খ) কোম্পানির হিসাবপত্র সম্পর্কে যদি তার কোনো ধারনা না থাকে তাহলে তিনি তার মালিকানাধীন শেয়ারের ওপর বার্ষিক অর্জিত মুনাফা যাকাতের জন্য বিবেচ্য অন্যান্য সম্পত্তির মূল্যের সঙ্গে যোগ করবেন এবং মোট মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।
(২) শেয়ার মালিক যদি শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা (মূলধনীয় মুনাফা) করার জন্য শেয়ারগুলো ব্যবহার করেন তা হলে যেদিন জাকাত প্রদানের ইচ্ছা হবে, শেয়ারের সেদিনের বাজার মূল্য ও ক্রয়-মূল্যের মধ্যে যেটি কম তারই ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে ২.৫% হারে জাকাত প্রদান করবেন। একজন শেয়ার মালিক ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। কোম্পানির শেয়ার ক্রয় ও বিক্রয়ের এই স্বাধীনতা শেয়ার বাজারকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটি সাধারণ ব্যবসা কার্যক্রমকে প্রায় জুয়াখেলায় পরিণত করে। ইহা ইসলামি শরীয়ার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ।
বানিজ্যিক সম্পদের জাকাত: ব্যবসার নিয়তে (পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ মুনাফা অর্জনের জন্য) ক্রয়কৃত, আমদানি-রফতানি পণ্য, ট্র্যানজিট বা পরিবহন পণ্য, বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য ও মজুদ মালামালকে ব্যবসার পণ্য বলে। ব্যবসার পণ্যের ওপর সর্বসম্মতভাবে জাকাত ফরজ। এমনকি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি,দালান বা যেকোনো বস্তু অথবা মালামালের মূল্যের ওপরও জাকাত প্রদান করতে হবে। বাকী বিক্রির পাওনা, এলসি মার্জিন ও আনুষঙ্গিক খরচ, ব্যবসার নগদ অর্থসহ অন্যান্য চলতি সম্পদ জাকাতের হিসাবে আনতে হবে। অন্যদিকে ব্যবসার দেনা যেমন বাকীতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন, মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস বিল, কর ইত্যাদি পরিশোধিত না থাকলে উক্ত পরিমাণ অর্থ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। জাকাত নির্ধারণের জন্য বিক্রেতা তার পণ্যের ক্রয়-খরচ মূল্যকে (ক্রয়মূল্যের সঙ্গে ভাড়াসহ ক্রয়-সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ যোগ করে) হিসাবে ধরবেন।
আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত-২৭৫)।
উৎপাদিত পণ্যের ওপর জাকাত: তৈরি বা উৎপাদিত পণ্য, উপজাত দ্রব্য, প্রক্রিয়াধীন পণ্য, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী ইত্যাদি জাকাতের আওতাভুক্ত হবে। জাকাত নির্ধারণের জন্য তৈরি বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্যায়ন উৎপাদন খরচ মূল্যের অথবা পাইকারী বাজার দরের ভিত্তিতে হবে। প্রক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্যের মূল্যায়ন ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খরচের ভিত্তিতে করতে হবে। মজুদ কাঁচামাল এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচামালের সঙ্গে ব্যবহৃত প্যাকিং সামগ্রী ক্রয়- খরচ মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব হবে এবং জাকাতের আওতাধীন পণ্যদ্রব্যসহ ব্যবসার নগদ অর্থ ও অন্যান্য চলতি সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করে জাকাত নির্ধারণ করতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পদ যেমন- জমি, দালান, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যানবাহন ইত্যাদির ওপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।
স্থায়ী সম্পত্তির জাকাত: স্থায়ী সম্পত্তি বলতে বুঝায় জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি।
(ক) বসবাস, ব্যবহার, উৎপাদন কাজে বা কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তির ওপর জাকাত ধার্য হয় না। (খ) আয় উপার্জনের জন্য ভাড়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- গৃহ, দোকান, দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদির ওপর জাকাত ধার্য হয় না। তবে এসব সম্পত্তি থেকে ভাড়া বাবদ অর্জিত নিট আয় অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করে ২.৫% হারে জাকাত প্রদান করতে হবে। (গ) বেচা-কেনার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- জমি, গৃহ, দোকান, এপার্টমেন্ট, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এগুলোর মূল্যের ওপর জাকাত ধার্য হবে।
ঋণদাতার ওপর জাকাত: (ক) আদায়যোগ্য ঋণ আদায় হওয়ার পর অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করে জাকাত প্রদান করতে হবে। (১) যে ঋণ নগদে বা কোনো দ্রব্যের বিনিময়ে কারো কাছে পাওনা হয়, এরূপ ঋণ আদায় হওয়ার পর জাকাত দিতে হবে, এবং বিগত বৎসরসমূহেরও জাকাত প্রদান করতে হবে। (২) যে পাওনা কোনো দ্রব্য বা নগদ ঋণের বিপরীতে নয়, যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ, দান, অসিয়ত, মোহরাণার অর্থ ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে আদায়ের পর জাকাত ধার্য হবে। এগুলোর ওপর বিগত বৎসরসমূহের জাকাত প্রদান করতে হবে না। (খ) আদায় অযোগ্য বা আদায় হবার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে ঋণ জাকাতের হিসেবে আসবে না। যদি কখনো উক্ত ঋণের টাকা আদায় হয়, তবে কেবলমাত্র… ১ বছরের জন্য উহার জাকাত দিতে হবে।
ঋণগ্রহিতার ওপর জাকাত: (ক) ঋণগ্রহিতার ঋণের টাকা মোট জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি (যেমন-অতিরিক্ত বাড়ী, দালান, এপার্টমেন্ট, জমি, মেশিনারী, যানবাহন, গাড়ী ও আসবাবপত্র ইত্যাদি) থাকে যাহা দ্বারা এরূপ ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম, তবে উক্ত ঋণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। (খ) স্থাবর সম্পদের ওপর কিস্তিভিত্তিক ঋণ (যেমন-হাউজিং লোন ইত্যাদি) জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। তবে বার্ষিক কিস্তির টাকা অপরিশোধিত থাকলে তা জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। (গ) ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেয়া হলে উক্ত ঋণের টাকা জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থাকে তবে উক্ত ঋণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। (ঘ) শিল্প-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। তবে যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা যায় তবে তা জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। (ঙ) যদি অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তির মূল্য ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম হয়, তবে ঋণের পরিমাণ থেকে তা বাদ দিয়ে বাকী ঋণের টাকা জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। বিলম্বে প্রদেয় বা পুণ:তপসিলিকৃত ঋণের বেলায় শুধুমাত্র ঋণের বার্ষিক অপরিশোধিত কিস্তি যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
পশুর জাকাত: উটের সর্বনিম্ন নিসাব পাঁচটি, গরু-মহিষের ত্রিশটি এবং ছাগল-ভেড়ার চল্লিশটি। তবে এ ধরণের পশু বৎসরের অর্ধেকের বেশি সময় মুক্তভাবে চারণভূমিতে খাদ্য গ্রহণ করলেই এসব পশুর ওপর সংখ্যা ভিত্তিক জাকাত ধার্য হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যেকোনো পশুসম্পদ প্রতিপালন করা হলে সেগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এদের ওপর জাকাত সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, মূল্যের ভিত্তিতে ধার্য হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে খামারে পালিত মৎস্য, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি এবং খামারে উৎপাদিত দুধ, ডিম, ফুটানো বাচ্চা, মাছের রেণু, পোনা ইত্যাদি ব্যবসার সম্পদ হিসেবে জাকাত প্রদান করতে হবে। প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ (সা:) পানিতে বাস করা অবস্থায় মাছ ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। মাছ যখন বিক্রির জন্য ধরা হবে তখনই এর জাকাত পরিশোধ করতে হবে।
শস্য ও ফলের জাকাত (উশর): শস্য ও ফলমূলের জাকাতকে উশর বলে। জমি থেকে উৎপন্ন সর্ব প্রকার শস্য, শাকশব্জি, তরি-তরকারি ও ফলের ওপর জাকাত প্রযোজ্য। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া, ঔষধি বৃক্ষ, চা বাগান, রাবার চাষ, তুলা, আগর, ফুল, অর্কিড, বীজ, চারা, কলম ইত্যাদি জাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ফসল আসার সঙ্গে সঙ্গে উশর পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নাই। বৎসরে একাধিকবার ফসল আসলে একাধিকবার উশর পরিশোধ করতে হবে। অনেক ধরনের ফল, ফসল ও শাকশব্জি একই সঙ্গে কাটা বা উত্তোলন করা যায় না। যেমন- মরিচ, বেগুন, পেঁপে, লেবু, কাঁঠাল ইত্যাদির পরিপক্কতা বুঝে কিছু কিছু করে কয়েকদিন পর পর পুরো কৃষি মৌসুমে বার বার উত্তোলন করা হয়। ফসলের মালিক যদি ফসলের আনুমানিক পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হন এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে প্রথম থেকেই প্রতি উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে উশর (জাকাত) পরিশোধ করবেন। যদি মালিকের পক্ষে ফলফসলের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হয়, তবে তিনি প্রথম উত্তোলন থেকে ফসলের হিসাব রাখবেন এবং যখনি মোট উত্তোলিত ফসলের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছবে তখনি ওই দিন পর্যন্ত মোট উত্তোলিত ফসলের জাকাত পরিশোধ করবেন এবং তৎপরবর্তী প্রতি উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে জাকাত পরিশোধ করবেন।
জ্বালানি কাঠ,আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণে ব্যবহার উপযোগী বৃক্ষের ক্ষেত্রে, এরূপ বৃক্ষ যখন কাটা হবে তখন এগুলোর ওপর জাকাত প্রযোজ্য হবে, তা যত দীর্ঘ সময় পর কাটা হউক না কেন। যে জমিতে সেচ প্রয়োজন হয় না, প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হয়, তার ফসলের জাকাত হবে দশ ভাগের একভাগ (১০%) আর যে জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়, তার ফসলের জাকাত হবে বিশ ভাগের একভাগ (৫%)। ফসল উৎপাদনের ব্যয় যেমন- চাষ, সার, কীটনাশক, বপন ও কর্তণ ইত্যাদি খরচ উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ থেকে বাদ যাবে, তবে এ সব খরচ মোট উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশি বাদ যাবে না। ফসলের নিসাবের পরিমাণ ৫ ওয়াস্ক বা ৬৫৩ কিলোগ্রাম। অনেক কৃষি ফসল আছে যা মাপা বা ওজন করা হয় না। যেমন বিভিন্ন ধরনের ফল, ফসল, শাকশব্জি, ফুল, অর্কিড, চারা, বৃক্ষ ইত্যাদি। এগুলোর নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ ফসল চাল বা গমের ৬৫৩ কেজির মূল্য (স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য) নিসাব হিসাবে গণ্য করা যাবে।
জাকাত আদায়ের নিয়ত: নিয়ত জাকাতের একটি গুরুত্ব রোকন। জাকাতের অংশ মূল সম্পদ হতে বের করার সময় নিয়ত অবশ্য করতে হবে। এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হতে হবে।
জাকাত আদায় করার সময়: নিসাবের মালিক হওয়ার পর এক বৎসর অতিবাহিত হলেই সঙ্গে সঙ্গে জাকাত ওয়াজিব হয়। বিলম্ব করা জায়েয নাই। তবে বর্ষপূর্তির পূর্বে আদায় করা জায়েয।