হারুন আনসারী:
ফরিদপুরের কুমার নদীর পাড়ে রথখোলা ও পশ্চিম খাবাসপুরের সীমানার মাঝখানে চৌধুরীদের বাড়ী। বিশালায়তনের এই চৌধুরী বাড়ির দিকে নদীর এপাড়ে পূর্ব খাবাসপুরের লঞ্চঘাট থেকে তাকালে ওপাড়ে নদীর তীরে একটা বড় সুউচ্চ ফটক নজরে আসতো। সেই চৌধুরীরা এখন আর নেই। দেশভাগের সময় অস্থাবর সব সহায়সম্পদ সাথে নিয়ে চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। তবে ওদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা এখনো শোনা যায় মুরুব্বিদের মুখে।
লোকমুখেই জানা গেছে এই অত্যাচারী জমিদারদের নানা কথা। দখলদার ইংরেজদের থেকে চৌধুরী উপাধি প্রাপ্ত এই জমিদারদের কারো নাম পরিচয় জানা যায়নি। ছোটবেলায় ওদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত বিল্ডিংগুলো দেখতাম আর নানা কথা জানতাম ওদের সম্পর্কে।
কুমার নদী হতে বড় ফটক দিয়ে বাড়ির সীমানায় প্রবেশের পর ছিলো একটা বৈঠকখানা। লম্বা ঘরটি সম্ভবত অতিথিদের বসানো হতো ড্রয়িং কাম ডাইনিং হিসেবে। সন্ধার পর সেখানে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা হতো। এই জমিদাররা তাদের আভিজাত্যপূর্ণ পরিচয় প্রকাশ করতো বাইজি নাচিয়ে। তখনকার প্রভাবশালী কিংবা রাজ কর্মচারীদের জন্য অনেক টাকা খরচ করে আনা হতো গান ও নাচের শিল্পী।
বলাই বাহুল্য, সাধারণ মানুষ বাড়ির চৌহদ্দিতেই ভিড়তে পারতো না। এই অতিথিশালা পেরিয়ে একটু উত্তরে বড় ডোয়া করে উঁচু করে তৈরি একটি ভবন। সম্ভবত এটি চৌধুরীদের প্রধান কাচারি ঘর ছিলো। ভবনটির সামনে কোন দরজা ছিলোনা, পিলারের ফাঁকের জায়গাটুকু খোলা। পেছনে একটি দরজা আছে। ঘরের কোনায় আছে গোপন কুঠুরি ও সিড়ি। এই ভবনটির দোতলায় ছাদের কাছে এমন একটি গোপন কক্ষ আছে যেখানে শুয়ে থাকলে কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পাবেনা। পুলিশের হাত হতে বাঁচতে অনেকেই সেখানে থাকতো এই সেদিনেও। এখানে কোন পূজার বেদি বা প্রতিমার কোন চিহ্ন ছিলোনা। তবে অনেক পরে এই নব্বই দশকের সময়ে এটি চৌধুরীদের মায়ের সার্বজনীন মন্দির ছিলো বলে দাবি করা হয়। এখন সেখানে একটি বড়সড় মন্দির করা হয়েছে। যেখানে রোজ সন্ধাবাতি ও পূজা করা হয়। পৃরোহিত নিয়োগ হয়েছে। বিশেষত ভাসমান যেসব পরিবার চৌধুরীদের বাড়িতে এখন ঘর তুলেছে তারা রোজই ওই মন্দিরে হাজির থাকে। অন্য অনেকেই সেখানে যায়। এই উঁচু ভবনের পেছনে আরেকটি দ্বিতল ভবন। সেখানে প্রহরী ও কর্মচারীরা থাকতো। এই দুইটি ভবনের মাঝামাঝি পশ্চিম দিকে রয়েছে মঠের মতো ছোট একটি মন্দির ঘর। এটিই আসল মন্দির ঘর বলে মনে করা হয়। ছোট কক্ষটির মাঝখানে পূজা আরাধনা করার পরিপাটি জায়গা। ঘরটি নেশাখোরদের কল্কে সেবনের নিরাপদ আখড়া বানিয়ে রাখা হয়েছিল। এই ঘরের পাশে পশ্চিম দিকে চৌধুরীদের মূল ভবন। সেখানেই তাদের পরিবার থাকতো। এই ভবনটিতে অনেকদিন হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। এখন সেখানে কিছু হিন্দু পরিবারও থাকে।
চৌধুরী বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ ছিলো চৌধুরীদের পুকুর। পুকুরটির দক্ষিণে শান বাঁধানো। আর উত্তরে পশ্চিম তীর ঘেঁষে মাজা সমান পানি জুড়ে নির্মাণ করা দেয়াল। চৌধুরীদের নারীরা সেখানে স্নান করতো বলে শুনেছি। এই পুকুরের সাথে পাশের কুমার নদের সংযোগ একটি সুরঙ্গ নালা ছিলো। আমরা বলতাম, এই পথেই চৌধুরীদের সিন্দুক নামতো। সম্ভবত, পুকুরটিতে নদীর পানি সরবারাহের জন্য এই সুরঙ্গ নালাটি বানানো হয়েছিলো। পকুরপাড় জুড়ে সারি সারি নারকেল গাছ। সড়কপথে বাস চলাচল শুরু হওয়ার পর এই চৌধুরী বাড়ির পূর্ব পাড় দিয়েই হাজি শরিয়তুল্লাহ বাজার হতে শুরু হয়ে তৈরি হয়েছিল প্রথম ফরিদপুর-বরিশাল সড়ক। এই পথে বাসও চলতো।
ছোটবেলা হতে জেনেছি, এই চৌধুরীদের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এমনকি মাথায় রোদবৃষ্টিতে ছাতি ফুঁটিয়েও চলতে পারতো না। তাদের ছিলো নিজস্ব বাহিনী। শহরের বুকে এই জমিদারদের উপার্জনের আর কি পথ ছিলো তা জানা যায়না। কারণ, একমাত্র নদীর মাছ ছাড়া চাষবাস করে প্রজাদের নিকট হতে খাজনা আদায়ের কোন কিছু জানা যায়না এদের ব্যাপারে।
আসলেই এই চৌধুরীরা একটা রহস্য। তাদের কোন নারী বা পুরুষের সঠিক নাম পরিচয় জানা যায়না। পাওয়া যায়না তাদের কোন সামাজিক কর্মকান্ডের ইতিহাস। শুধু কিছু অবর্ণনীয় বর্বরতার তথ্য ছাড়া।
লোকমুখে শুধু এটুকুই জানা যায়, ভিষণ অত্যাচারী আর স্ফুর্তিবাজ ছিলো এই জমিদার চৌধুরীরা। তখন বিয়েশাদিতে নৌপথেই যেতো বরযাত্রা। কুমার নদীতে এমন কোন বরযাত্রা দেখা গেলে সেটিকে আটকানো হতো। তারপর নববধুকে প্রথম রাতে চৌধুরীদের মনোরঞ্জনে সমর্পন করা হতো। তারপর ওই বধুর ভাগ্যে কি হতো তা সঠিকভাবে জানা যায়না। বিশেষত মুসলমান প্রজাদের উপর তারা খড়গহস্ত ছিলো বলে জেনেছি। এসব তথ্যের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের কোন উপায় নেই এখন। তবে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার আর সহায় সম্পদ নিয়ে ঘরবাড়ি পরিত্যক্ত করে এভাবে দেশছাড়ার যেই নজির, তাতে এখানে যে তাদের কোন শুভাকাঙ্খি ছিলোনা তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আগেই বলেছি, কোন জনহিতকর বা প্রজাবান্ধব কোন কর্মকান্ডের ইতিহাসও তাদের নেই শুধুই বদনাম ছাড়া।
মুরুব্বীরা বলেছেন, কোনো মুসলমান যুবক বিয়ে করে নববধুকে নিয়ে এই পথে বাড়ি ফিরতে পারতোনা। প্রথম রাতে নববধুকে ভোগ করতো চৌধুরীরা। এভাবে কতো প্রাণের নতুন জীবন গড়ার রঙিন স্বপ্ন তছনছ হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
পাকিস্তান আমলে চৌধুরী বাড়ির পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা মস্ত মস্ত বিল্ডিং আস্তে আস্তে বহিরাগতদের দখলে যেতে থাকে। সরকার সেখানে একটি সমবায় অফিস করে। পরে সেখানে সেই অফিসের জন্য বহুতল ভবনও নির্মাণও করেছে। এছাড়া নানাভাবে সেখানে ভুমিহীন বেশকিছু হিন্দু পরিবার স্থানীয় একটি চক্রের মাধ্যমে সেখানে বসত গড়ে তুলেছে৷ সরকার ও পাবলিকের তৎপরতায় সেখানে এই দখলবাজি শুধু চৌধুরী বাড়ির সীমানার মধ্যেই আটকে থাকেনি; বেশ কয়েকবছর আগে থেকে ওখানকার নদীর পাড়ও দখল হয়ে ঘরবাড়ি উঠে গেছে। ভুমিহীন দরিদ্র এসব পরিবারের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশান নেয়াটা সম্ভব হয়না। এর বাইরে চৌধুরীদের বাড়ির উত্তর পাশের লাগোয়া বড় একটা জায়গা সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল আশির দশকের দিকে। তারপাশে একটি পুরনো দ্বীতল ভবনে অনেক দিন ঝুলতো তাতীদের সমবায় সমিতির একটি সাইনবোর্ড। পাশে ছিল বড় পুকুর। জীবনে কোনদিন এদিকে তাতিদের দেখিনি। তাই তাতীদের সমিতির ওই সাইনবোর্ডটি আমার কাছে বেশ বিস্ময়কর লাগতো। তাতীদের সাইনবোর্ড ঝোলানো এই বিল্ডিং, পাশের পুকুর সবই ভরাটের পর সমান করে বিক্রি হয়ে গেছে।
অনেকে মনে করেন, চৌধুরীদের এই বাড়িটি এভাবে বেদখলে না রেখে সেখানে সরকার পরিতল্পিতভাবে একটা বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক গড়ে তুলতে পারতো। বিশেষ করে কুমার নদীর পাড় জুড়ে নয়নাভিরাম স্থান গড়ে তুললে এই শহরের বাসিন্দারা একটা অবকাশ যাপনের সুযোগ পেতো। তবে একটি মহল শুরু থেকেই এই স্থানটিকে আড়াল করে রাখতে চাইছে। পুরো চৌধুরী বাড়ি জুড়ে একটি বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। সেসব না করে বরং এখানকার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুটপাটের বিষয়টি সরকারের নজরের বাইরেই রয়ে গেছে।